চার জন
তিন জন
দুই জন
এক জন
আলি
মিঠু
মধু
শাহাবুদ্দিন
স্বাধীনতা ভীষণ আনন্দের। স্বাধীনতা খুব দরকার।
শফিক মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে। একদিন রাজাকার সুরুজ আলি শফিককে ধরে পাকসেনাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। কিন্তু শফিক মৃত্যুভয়ে মোটেই ভীত হয় না।
গ্রামে ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে গেলে অধিকাংশ গ্রামবাসী গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া রাকিব গ্রাম ছেড়ে যেতে চায় না। সে বলে, গ্রামটা আমার। এখান থেকে আমি এক পাও নড়ব না।
নৌসেনা বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও প্রাণপণ যুদ্ধ করে। তাঁর যুদ্ধ জাহাজ পলাশকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানিদের গোলার আঘাতে জাহাজে আগুন ধরলে তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন। এ সময় তীরের ঘৃণ্য রাজাকাররা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
ক. উপন্যাসের ধারণা ও সংজ্ঞা
উপন্যাস গদ্যে লেখা এক ধরনের গল্প। মানুষ গল্প বলতে ভালোবাসে। সুপ্রাচীনকাল থেকেই এটা চলে আসছে। মানুষ তখন মুখে মুখে গল্প বলত। লিখে রাখার চল ছিল না। পরে এরই ধারাবাহিকতায় আবির্ভাব ঘটে উপন্যাসের। তবে উপন্যাস শুধু চোখে দেখা গল্প নয়, এ হচ্ছে এক ধরনের সৃষ্টিশীল রচনা। মানুষের জীবনই হচ্ছে উপন্যাসের উৎস। এই জীবনে যেসব ঘটনা ঘটে, সেই সব ঘটনার সঙ্গে লেখকেরা নিজের ভাবনা, কল্পনাকে মিশিয়ে দিয়ে রচনা করেন উপন্যাস। উপন্যাসে তাই আমরা পাই ঔপন্যাসিকের জীবনানুভূতির প্রকাশ। এভাবেই উপন্যাস হয়ে উঠেছে এক ধরনের সৃষ্টিশীল রচনা। মানুষ এরপর যখন লিখে রাখতে শেখে, তখনই আবির্ভাব ঘটে উপন্যাসের। পনেরো শতকে ছাপাখানার আবির্ভাবের পর বিলুপ্তি ঘটে গল্পকথকদের। শুরু হয় আধুনিক উপন্যাসের কাল। প্রথমে এই আধুনিক উপন্যাসের সূত্রপাত ঘটে ইউরোপে, পরে তা ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। শুরু হয় আধুনিক উপন্যাস লেখা ।
শুরুতেই বলেছি, উপন্যাসে থাকে একটি প্রধান বা মূল গল্প। এই গল্পটিকে গড়ে তোলার জন্যে থাকতে পারে আরও কিছু পার্শ্বগল্প। ফলে, উপন্যাসের আকার সাধারণত ছোট হয় না, আবার এটি নিতান্ত ছোট গল্পও নয়। তবে এর আকার কতটুকু হবে, মূল গল্পটি গড়ে তুলতে গিয়ে পার্শ্বগল্পের আশ্রয় নেওয়া হবে কি না, এ বিষয়ে সাহিত্য তাত্ত্বিকগণ একমত হতে পারেন নি ই. এম. ফস্টার তাঁর আসপেক্টস্ অব দ্য নভেল গ্রন্থে বলেছেন, উপন্যাস হচ্ছে 'সুনির্দিষ্ট আয়তনের গদ্যকাহিনি' (prose of a certain extent)। এই আয়তনের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছেন, উপন্যাসের শব্দসংখ্যা কমপক্ষে পঁচিশ হাজার হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে এর সর্বোচ্চ সংখ্যা কত হবে, ফস্টার সে সম্পর্কে কিছু বলেন নি প্রখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রস্তের লেখা একটি উপন্যাসের (In Search of Lost Time) শব্দসংখ্যা বারো লাখের মতো। এটিই এ পর্যন্ত লেখা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপন্যাস। লেভ তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিসের শব্দসংখ্যাও অনেক – পাঁচ লাখ সাতাশি হাজারের মতো। ইতালির বিখ্যাত নন্দনতাত্ত্বিক ও ঔপন্যাসিক উমবার্তো একো আবার সাত শব্দের এক বাক্যে রচিত একটি লেখাকে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম উপন্যাস বলে দাবি করেছেন। শুধু আকার নয়, উপন্যাসের প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও সাহিত্য তাত্ত্বিকগণ একমত হতে পারেন নি। এর কাহিনি কীভাবে উপস্থাপন করা হবে, কাহিনির বিষয়-আশয় কী হবে, ভাষারীতির ধরন কেমন হবে- এসব বিষয়ে সাহিত্য তাত্ত্বিকগণ নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রকাশের জন্য আলাদা আলাদা পথ বেছে নিয়েছেন।
তবে এসব পার্থক্য সত্ত্বেও কিছু কিছু বিষয়ে যে মিল নেই, এমন নয়। এমন সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের কারণেই উপন্যাস বিশেষ এক ধরনের সৃষ্টিশীল রচনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। যেমন, ঔপন্যাসিক যে গল্পটি নির্মাণ করেন, সেটি নির্মাণ করা হয় বর্ণনার সাহায্যে। গদ্য আর সংলাপের মাধ্যমে। উপন্যাসের এই বর্ণনাকে বলে 'ন্যারেটিভ' (Narrative)। সুবিন্যস্তভাবে এর কাহিনিকে উপন্যাসে তুলে ধরা হয়। বাংলায় ব্যবহৃত 'উপন্যাস' শব্দটির মধ্যেও এই বিন্যাসের কথা আছে। 'উপ' উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘ন্যাস'। এই ন্যাসই হচ্ছে বিন্যাস। বাংলায় ব্যবহৃত এই শব্দটির সংস্কৃত ব্যুৎপত্তি হচ্ছে এ রকম : উপ+নি+অস+অ= উপন্যাস।
ইংরেজিতে এর দুটি প্রতিশব্দ আছে : Novel, Fiction। নভেল শব্দটি এসেছে ইতালির novella থেকে। এর অর্থ : ale (গল্প) বা কাহিনি। ফিকশনের উৎস হচ্ছে fact (ঘটনা) বা গল্প ।
উপন্যাসের কয়েকটি সংজ্ঞা
সাহিত্যের বিশেষ রূপ হিসেবে উপন্যাসের সংজ্ঞা দেওয়া খুব সহজ নয়। এর আকার আর প্রকৃতি নিয়ে আছে ভিন্নমত। ফলে এর সুনির্দিষ্ট কোনো সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। তবু এর সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে উপন্যাসের যেসব সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে সেগুলো এ রকম :
গ্রন্থকারের ব্যক্তিগত জীবন-দর্শন ও জীবনানুভূতি কোনো বাস্তব কাহিনি অবলম্বন করিয়া যে বর্ণনাত্মক শিল্পকর্মে রূপায়িত হয়, তাহাকে উপন্যাস কহে । ['উপন্যাস', সাহিত্য-সন্দর্শন, শ্রীশচন্দ্র দাস, কথাকলি, ঢাকা, ১৯৭৬।] ইংরেজিতে ‘নভেল’ এক বিশেষ ধরনের সাহিত্য-সংরূপ। গদ্যে লেখা সুদীর্ঘ বর্ণনাত্মক সাহিত্যকর্ম।
[উপন্যাস', সাহিত্য শব্দার্থকোষ, সুরভি বন্দ্যোপাধ্যায়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ. ২৯।]
An invented prose narrative of considerable length and a certain complexity that deals imaginatively with human experience, usually through a connected sequence of events involving a group of persons in a specific setting, is called a novel. [The Britannica Guide to Literary Elements: Prose Literary Terms and Concepts, Ed. by Kathleen Kuiper, Britannica Educational Publishing, New York, 2012, p. 1. ]
The term "novel" is now applied to a great variety of writings that have in common only the attribute of being extended works of fiction written in prose. ['Novel', A Glossary of Literary Terms (9th. Edition), M. H. Abrams and Geoffrey Galt Harpham, Wadsworth Cengage Learning, Boston, 2009, p. 226.]
সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, উপন্যাস হচ্ছে অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালের সৃষ্টি। সাহিত্যের আদিরূপ হিসেবে প্রথমে সৃষ্টি হয়েছিল কবিতা, মহাকাব্য, আখ্যানকাব্য। পরে মানুষের জীবন জটিল হয়ে উঠতে থাকলে আবির্ভাব ঘটে উপন্যাসের। নিজের কথা, চারপাশের মানুষের কথা, সমাজের কথা বলার তাগিদ থেকেই কাহিনির আশ্রয় নেন লেখকেরা। রচনা করতে থাকেন উপন্যাস। উপন্যাসে তাই লেখকের জীবনদর্শন ও জীবনবোধের প্রকাশ লক্ষ করি আমরা। জীবনের সমগ্রতাই প্রতিফলিত হয় উপন্যাসে। এটাই হচ্ছে উপন্যাসের মর্মকথা। সতেরো শতকের হিস্পানি ঔপন্যাসিক সার্ভেন্তাসের ডন কিহোতো থেকে আধুনিককালের এই বোধেই পৌঁছেছেন ঔপন্যাসিকেরা।
খ. উপন্যাসের আঙ্গিক ও গঠনকৌশল
উপন্যাসের কাহিনি কীভাবে গড়ে তোলা হবে, সেটাই হচ্ছে উপন্যাসের আঙ্গিক ও গঠনকৌশলের দিক । প্রায় চার শত বছর ধরে নানা চর্চার মধ্য দিয়ে সাধারণভাবে উপন্যাস যেসব উপাদানের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে সেগুলো নিম্নরূপ :
১. কাহিনি বা আখ্যানভাগ (plot)
২. চরিত্র (character)
৩. দৃশ্য/পরিবেশ (scene or setting) ৪. বর্ণনাভঙ্গি (narrative method),
৫. ভাষা (diction) এবং
৬.ঔপন্যাসিকের জীবনভাবনা (Author's philosophy)
উপন্যাসের প্রধান উপাদান এর কাহিনি বা গল্প। এই কাহিনি হতে পারে, সরল আবার জটিল। নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসে দেখা যায়, গল্পের প্রাধান্য তেমন থাকে না। ভাষা বা বলার ভঙ্গিটাই প্রধান হয়ে ওঠে। অ্যাবসার্ড উপন্যাস কিংবা ফরাসি নব্য (nouveau) উপন্যাস এভাবেই লেখা হয়েছে। তবে সাধারণভাবে কতগুলো ছোট ছোট বা উপকাহিনির সাহায্যে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে তোলা হয়। উপন্যাসে উপস্থাপিত এই কাহিনিকে বলা হয় আখ্যানভাগ (plot) বা কাহিনি-সমগ্র ।
উপন্যাসের দ্বিতীয় উপাদান চরিত্র। চরিত্রের আচার-আচরণ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে উপন্যাস । উপন্যাসে এক বা একাধিক চরিত্র থাকে। এর কোনটি হবে প্রধান চরিত্র, বা আদৌ কোনো প্রধান চরিত্র থাকবে কি না, সেসব নির্ভর করে ঔপন্যাসিকের ওপর। চরিত্রগুলো যেসব ঘটনা ঘটায় তার মধ্য দিয়েই উপন্যাসের কাহিনি অগ্রসর হতে থাকে। চরিত্রের বিকাশের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের কাহিনিও বিকশিত হয়। উপন্যাস পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় । উপন্যাস হচ্ছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই ক্রমবিকশিত চরিত্রেরই কাহিনি। উপন্যাসের আরেকটি উপাদান হচ্ছে এর নানান দৃশ্য বা পরিবেশ। বিভিন্ন টুকরো টুকরো দৃশ্য বা পরিবেশের সমন্বয়েই উপন্যাসের কাহিনিকে গেঁথে তোলেন ঔপন্যাসিক। চরিত্রের মনোভাব এবং আচার-আচরণের গতিপ্রকৃতির ওপর নির্ভর করেই গড়ে ওঠে এই পরিবেশ। বর্ণনারীতি হচ্ছে উপন্যাসের আরেকটি উপাদান। উপন্যাসে আমরা যে দৃশ্য, পরিবেশ বা কাহিনির কথা পাই তা বিভিন্ন ভঙ্গির সাহায্যে নির্মাণ করা হয়। কোথাও চরিত্র নিজের ভাষায় নিজের গল্প বলে, কোথাও ঔপন্যাসিক উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনা করেন। কোথাও থাকে শুধুই তথ্য, কোথাও ঔপন্যাসিক আবেগময় কাব্যিক ভাষায় কাহিনির কাঠামো গড়ে তোলেন। সেদিক থেকে দেখলে ভাষা হচ্ছে উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কেননা, উপন্যাস লেখা হয় ভাষার মাধ্যমে। ভাষা দিয়েই বর্ণনা করা হয় সবকিছু। সৃষ্টি করা হয় বিশেষ বিশেষ পরিবেশ। যথাযথ স্থানে যথার্থ ভাষার ব্যবহার না থাকলে উপন্যাস হয়ে ওঠে না। তবে উপন্যাসের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করে লেখকের জীবনভাবনা বা জীবনদর্শন। লেখকের বলা কথাটিই হচ্ছে তাঁর জীবনদর্শন। শেষ পর্যন্ত আমরা একটি উপন্যাসের কাহিনিতে এই জীবনদর্শনই প্রতিফলিত হতে দেখি। সামগ্রিকভাবে বললে, উল্লিখিত সবগুলো উপাদান মিলিয়েই লেখা হয় উপন্যাস ।
গ. বাংলা উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আগেই বলেছি, উপন্যাস আধুনিক কালের সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে মাত্র দেড় শত বছর আগে ইংরেজি উপন্যাসের আদলে উপন্যাস রচনার সূত্রপাত ঘটে। তবে অনেকেই এর বীজ খুঁজে পেয়েছেন প্রাচীন সংস্কৃত কাহিনি-কাব্য, পঞ্চতন্ত্র ও বৌদ্ধ জাতকের গল্প, মধ্যযুগের রূপকথা, ময়মনসিংহ গীতিকা, রোমান্টিক কাহিনি-কাব্য, নাথ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য, আরব্য উপন্যাস, লোকগাথা প্রভৃতি রচনায়। এভাবে দেখলে, আধুনিক কালের পূর্বে বাংলা উপন্যাসের কোনো নিদর্শন খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত ঘটলে কলকাতাকে কেন্দ্র করে একদিকে ব্যাপক নগরায়ণ, অন্যদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে। ইউরোপীয় শিক্ষার প্রভাবে মানবিকতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, শিক্ষা ও সাময়িক পত্রের প্রসার, সমাজ সচেতনতা ইত্যাদি বৃদ্ধি পায়। নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের দ্বারা সমাজ ক্রমশ জটিল হয়ে পড়ে। নতুন কালের মানুষ নতুন সমাজের কথা প্রকাশের গরজ অনুভব করতে থাকে। এরই প্রভাবে উদ্ভব ঘটে উপন্যাসের।
অনেকে মনে করেন,হানা ক্যাথারিন মুলেন্সের (১৮২৬-৬১) লেখা ফুলমনি ও করুণার বিবরণ (১৮৫২) হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস। কেউ কেউ আবার প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) এর মধ্যে উপন্যাসের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন। তবে সবাই মেনে নিয়েছেন, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৩৮-৯৪) দুর্গেশ নন্দিনী (১৮৬৫) হচ্ছে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্রই প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা উপন্যাসের স্রষ্টা। উপন্যাসের সমস্ত লক্ষণ তাঁর উপন্যাসে দেখা যাবে। তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। লিখেছেন সামাজিক উপন্যাস। সমাজের নানা অসংগতি, ব্যক্তির কামনা, বাসনা, বেদনা ও দ্বন্দ্বের কথা চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে তাঁর উপন্যাসে। কাহিনি বর্ণনা, চরিত্রচিত্রণ, ভাষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি সাফল্য দেখিয়েছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে কপালকুণ্ডলা, বিষবৃক্ষ, কৃষ্ণকান্তের উইল ইত্যাদি ।
বাংলা উপন্যাসের আরেক কীর্তিমান লেখক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। উপন্যাস রচনাতেও তাঁর সাফল্য ঈর্ষণীয়। ব্যক্তির মন ও মননের অপূর্ব সমন্বয়ে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উপন্যাসগুলো রচনা করেছেন। বঙ্কিমের উপন্যাসে আমরা দেখেছি সমাজের চাপে ব্যক্তি আত্মপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। তাঁর চত্রিরগুলো সীমাহীন দুর্ভোগের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে পাওয়া গেল নতুন কালের নারী ও পুরুষকে। মানবিকতার দ্বারা দীক্ষিত হয়ে তারা সামাজিক সংস্কারকে অস্বীকার করছে। নারী-প ী-পুরুষের সমানাধিকারের ভিত্তিতে অর্জন করতে চাইছে আত্মপ্রতিষ্ঠা। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে চাইছে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। কাহিনি নির্মাণ, চরিত্র চিত্রণ, ভাষার নিরীক্ষা, যুগের প্রতিফলন, মনোবিশ্লেষণ ইত্যাদি দিক থেকে রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলো উল্লেখযোগ্য। তাঁর লেখা বহুল আলোচিত উপন্যাসগুলো হচ্ছে চোখের বালি, গোরা, ঘরে বাইরে, চার অধ্যায় ও যোগাযোগ।
রবীন্দ্রনাথের পরে বাঙালির গৃহকাতরতা এবং আবহমান পারিবারিক আবেগের ওপর ভর করে উপন্যাস লিখেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)। অর্জন করেছিলেন ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে চরিত্রহীন, গৃহদাহ, দেবদাস, দেনা-পাওনা, শ্রীকান্ত ইত্যাদি ।
বাংলা উপন্যাসের জগতে এরপর আবির্ভাব ঘটে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের- তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৮-১৯৭১), বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৯০৮-১৯৫৬)। আবহমান বাংলার প্রাকৃতিক মাধুর্য, পল্লির স্নিগ্ধ শান্ত রূপ, অরণ্য, পাহাড় যে এখনো আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, তাঁর লেখা পথের পাঁচালী, অপরাজিতা, আরণ্যক ইত্যাদি উপন্যাস পড়লেই তা বোঝা যায়। তারাশঙ্করের উপন্যাসে পাই অতীতের গৌরব আর ঐশ্বর্য হারানো জমিদার, নিম্নশ্রেণির বিচিত্র পেশার সাধারণ মানুষের কথা। এই মানুষজন আমাদের চিরচেনা বৈষ্ণবী, কবিয়াল, যাত্রাশিল্পী, মৃৎশিল্পী, বেদে, সাপুড়ে, বাজিকর, ঝুমুর দলের নাচিয়ে ইত্যাদি। উঠতি শিল্পমালিক আর শ্রমিকদের জীবনের ছবিও পাওয়া যাবে তাঁর উপন্যাসে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে— গণদেবতা, পঞ্চগ্রাম, ধাত্রীদেবতা, হাসুলী বাঁকের উপকথা, কবি প্রভৃতি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের প্রধান দুটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে : (১) মার্কসবাদের পটভূমিতে ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব এবং (২) ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণের আলোকে নর-নারীর জটিল সম্পর্ককে তিনি উপন্যাসে তুলে ধরেছেন। ঔপনিবেশিক শাসনের দ্বারা জর্জরিত মানুষের জীবনের ছবি তাঁর উপন্যাসে উজ্জ্বল । সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে গ্রামীণ বাস্তবতার চিত্র। দিবারাত্রির কাব্য, পদ্মানদীর মাঝি, পুতুল নাচের ইতিকথা, চিহ্ন, শহরতলী প্রভৃতি তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস। বাংলা উপন্যাস আরও যাঁরা লিখে খ্যাতিমান হয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন : জগদীশ গুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ী, কমলকুমার মজুমদার, দেবেশ রায়, মহাশ্বেতা দেবী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ।
ঘ. বাংলাদেশের উপন্যাসের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
১৯৪৭ সালে রাজনৈতিকভাবে ভারত বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ব বাংলায় সূচনা ঘটে নতুন এক সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার। এই সময়েই যাত্রা শুরু হয় বাংলাদেশের উপন্যাসের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলটি ছিল পাকিস্তানের উপনিবেশ। ঢাকাকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবনের আবির্ভাব ঘটলেও গ্রামীণ জীবন ছিল একই রকম। ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, গ্রামীণ কুসংস্কার, দারিদ্র্য ইত্যাদির দ্বারা বিপন্ন হয়ে পড়েছিল মানুষের জীবন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীনতা। জাতীয় জীবনে দেখা দেয় নতুন উদ্দীপনা। জনজীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া যেমন লাগে, তেমনি গ্রামীণ জীবনের টানও ছিল সমান। এই পটভূমিতে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা লিখেছেন নানা ধরনের উপন্যাস। শ্রেণিকরণ করলে বাংলাদেশের উপন্যাসকে এভাবে বিন্যস্ত করা যেতে পারে :
(১) গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত উপন্যাস : সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র লালসালু, কাঁদো নদী কাঁদো, চাঁদের অমাবস্যা, আবু ইসহাকের সূর্য-দীঘল বাড়ি, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, আবদুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্রদ্বীপের উপাখ্যান, শওকত ওসমানের জননী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা, হাসান আজিজুল হকের আগুনপাখি, সৈয়দ শামসুল হকের মহাশূন্যে পরান মাস্টার, সেলিনা হোসেনের দীপান্বিতা ইত্যাদি ।
(২) নগর ও গ্রামের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস : আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষুধা ও আশা, শহীদুল্লাহ্ কায়সারের সংশপ্তক, সরদার জয়েন উদ্দিনের অনেক সূর্যের আশা, আবুল ফজলের রাঙাপ্রভাত, আনোয়ার পাশার নীড় সন্ধানী ইত্যাদি।
(৩) নগর জীবনের পটভূমিতে রচিত উপন্যাস : আবুল ফজলের জীবন পথের যাত্রী, রশীদ করীমের উত্তম পুরুষ ও প্রেম একটি লাল গোলাপ, আবু রুশদের সামনে নতুন দিন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের চিলেকোঠার সেপাই, শওকত আলীর দক্ষিণায়নের দিন ইত্যাদি ।
(৪) আঞ্চলিক ও বিশেষ জীবনধারার উপন্যাস : আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্ণফুলি, শহীদুল্লাহ্ কায়সারের সারেং বউ, শামসুদ্দীন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা, আবু ইসহাকের পদ্মার পলি, সরদার জয়েনউদ্দিনের পান্নামতি, শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন, সেলিনা হোসেনের পোকামাকড়ের ঘরবসতি ইত্যাদি।
(৫) মনস্তত্ত্ব ও দার্শনিক উপন্যাস : আলাউদ্দিন আল আজাদের তেইশ নম্বর তৈলচিত্র, সৈয়দ শামসুল হকের দেয়ালের দেশ ও এক মহিলার ছবি, শওকত আলীর পিঙ্গল আকাশ, মাহমুদুল হকের খেলাঘর ইত্যাদি ।
(৬) ঐতিহাসিক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস : আবু জাফর শামসুদ্দিনের ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান ও পদ্মা মেঘনা যমুনা, শামসুদ্দীন আবুল কালামের আলম গড়ের উপকথা, সত্যেন সেনের অভিশপ্ত নগরী, আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত, শওকত ওসমানের জলাঙ্গী, রিজিয়া রহমানের বং থেকে বাংলা, মাহমুদুল হকের জীবন আমার বোন, হাসান আজিজুল হকের বিধবাদের কথা, সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড ও গায়ত্রী সন্ধ্যা, হুমায়ুন আহমেদের আগুনের পরশমনি, জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প, দেয়াল ইত্যাদি। এই বিভাজন ছাড়াও বয়সভেদে নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাস রচনা করেছেন বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা। ফলে তাঁরা যেমন বড়দের জন্য উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন ছোটদের জন্যও।
সব মিলিয়ে বলা যায়, বিচিত্র ধারায় বাংলাদেশের উপন্যাস বিকশিত হয়েছে। গ্রামীণ মানুষের জীবন ও শহুরে জীবন, ব্যক্তিক সংগ্রাম ও জাতিগত সংগ্রাম, ইতিহাস ও রাজনীতি- সবকিছুই বাংলাদেশের উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। চরিত্রচিত্রণ, ভাষা, আখ্যানশৈলী ইত্যাদি নানা দিক থেকে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকেরা।
ঙ. কাকতাড়ুয়া উপন্যাস ও ঔপন্যাসিক পরিচিতি : সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন ১৯৪৭ সালের ১৪ জুন রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মোশাররফ হোসেন, মাতার নাম মরিয়মন্নেসা বকুল। তিনি পিতামাতার চতুর্থ সন্তান। ১৯৬০-এর দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখালেখির সূচনা। এ পর্যন্ত বড়দের জন্য তাঁর প্রকাশিত উপন্যাসের সংখ্যা তেত্রিশ, ছোটদের পঁচিশ। সেলিনা হোসেনের লেখার জগৎ বাংলাদেশের মানুষ, তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। তাঁর উপন্যাসে প্রতিফলিত হয়েছে সমকালের সামাজিক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-সংকটের সামগ্রিকতা। বাঙালির অহঙ্কার ভাষা-আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তাঁর লেখায় নতুন মাত্রা অর্জন করেছে। ইংরেজি, রুশ, ফরাসি, হিন্দি, জাপানি, কোরিয়ান, ফিনিশ, উর্দু, আরবি, মালে, মালায়লাম ইত্যাদি বেশ কয়েকটি ভাষায় তাঁর বেশ কিছু গল্প ও উপন্যাস অনূদিত হয়েছে। বিদেশি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর উপন্যাস পাঠ্যসূচিভুক্ত হয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে : হাঙর নদী গ্রেনেড, পোকামাকড়ের ঘরবসতি, নীল ময়ূরের যৌবন, গায়ত্রী সন্ধ্যা, পূর্ণছবির মগ্নতা, যমুনা নদীর মুশায়েরা, ভূমি ও কুসুম। একুশে পদক, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ পেয়েছেন দেশের প্রধান প্রধান সব পুরস্কার। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন সুরমা চৌধুরী আন্তর্জাতিক স্মৃতি পুরস্কার (ভারত)। ২০১০ কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। কর্মজীবনে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালক ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন। এখন সার্বক্ষণিকভাবে লেখালেখি, নারী উন্নয়ন আর মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন।
উপন্যাসের আলোচনা : কাকতাড়ুয়া
বাংলাদেশের কোনো একটি গ্রাম। এই গ্রামেরই এক কিশোর বুধা। এক চাচি আর চাচাতো বোন কুন্তি ছাড়া তিন কুলে আপন বলতে কেউ নেই। তবে আজ না থাকলেও একদিন ছিল। সে বছর দুয়েক আগের কথা। বাবা-মা ছাড়াও ছিল দুই বোন আর এক ভাই। সবচেয়ে ছোট বোন বিনুর বয়স ছিল দেড় বছর। ছিল পিঠাপিঠি এক ভাই তালেব আর বোন শিলু ।এই ভাই-বোনদের নিয়ে ভালোই কাটছিল তার দিনগুলো। কিন্তু একরাতে সব শেষ হয়ে গেল। কলেরায় মারা গেল সবাই । ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেল বুধা। চাচির বাড়িতে প্রথমে আশ্রয় মিলেছিল। কিন্তু দারিদ্র্যের কথা তুললে বুধা সেই বাড়ি ত্যাগ করে। সেই থেকে বুধা একা। যখন যেখানে খুশি রাত কাটায়। যা খুশি তাই করে। যখন যা জোটে তাই দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে। পুরো গ্রাম আর হাটবাজার হয়ে উঠল তার বিচরণক্ষেত্র । চেনাজানা সব মানুষ হয়ে উঠল তার আপনজন । এভাবে দিন যায়, দিন আসে। কিন্তু একদিন ঐ গ্রামে মিলিটারি ঢুকে পড়ল । পুড়িয়ে দিল বাজারের দোকানপাট। বিস্মিত বুধা, কেন মিলিটারিরা এমন করল ? কী এমন অপরাধ করেছে বাংলাদেশের মানুষ? ভীষণ ক্ষুব্ধ হলো সে। ভাবল,এর প্রতিকার হওয়া দরকার। প্রতিশোধ নেওয়া দরকার। বুঝতে তার অসুবিধা হলো না, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ কী, তা সে বোঝেই না। তবে এটা বুঝেছিল, ঐ মিলিটারিরা বিদেশি। বাংলাদেশের মানুষ নয়। এদের বিরুদ্ধে লড়াই করা জরুরি। শুধু এরা নয়, যারা এদের সহায়তা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও লড়াই করতে হবে। অন্যদের মতো গ্রাম ছেড়ে সে পালিয়ে যাবে না। কিন্তু সে তো খুব ছোট, যুদ্ধ করবে কী করে?
এক রাতে মুক্তিযোদ্ধা আলি ও মিঠু রাতের আঁধারে গ্রামে এলো। বুধাকে বলল স্কুলের মিলিটারি ক্যাম্পটা উড়িয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়লো বুধা । প্রথমে পুড়িয়ে দিল শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ মুন্সির বাড়ি তারপর রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিল। বাপ-মা হারানো কিশোর বলে কেউ তাকে তেমন একটা সন্দেহ করল না। তারপর এলো সেই দিন। মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা শিল্পী শাহাবুদ্দিন তাকে মাইন পেতে ক্যাম্পটা উড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দিলেন। বাঙ্কার খোঁড়বার সময় কৌশলে সে তার ভেতর মাইন পুঁতে চলে এলো নদীর ধারে। এখানেই অপেক্ষা করছিলেন শাহাবুদ্দিন এবং তাঁর সহযোদ্ধারা। এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ । পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কারে ঢুকতেই পুরো ক্যাম্পটা মাইনের বিস্ফোরণে উড়ে গেল। নদীতে নৌকায় বসে শাহাবুদ্দিন, বুধা শুনতে পেল সেই শব্দ। তাদের অভিযান সফল হলো। নৌকা সরে গেল নিরাপদ দূরত্বে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের কাহিনি। এক সাহসী কিশোর মুক্তিযোদ্ধার কাহিনি।
আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, উপন্যাসটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত। এর আখ্যানভাগ বা প্লটটিকে চমৎকারভাবে গড়ে তুলেছেন সেলিনা হোসেন। শুরুটা এ রকম :রাত পোহালে দিনের আলো, সুয্যি ডুবলে আঁধার। ওর কাছে দুটোই সমান। হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যে কোথায় যায় সে হিসেব রাখে না। ওর কাছে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব সমান। মনে করে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ওর জন্যে রাস্তা খোলা। এই হচ্ছে কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বুধার কথা। এরপর বুধার চরিত্রটিকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন সেলিনা হোসেন। বুধা কিশোর হলেও অসীম সাহস আর মানবিক গুণাবলির অধিকারী সে। দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, বিদেশি মিলিটারিদের প্রতি ঘৃণা, দেশাত্মবোধ তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। খুবই স্বাভাবিক মনে হয় তার এই আচার-আচরণ। দেশকে ভালোবাসে বলে ধীরে ধীরে সে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে বলা যায়, দেশপ্রেমের এক অনবদ্য কাহিনী এটি। ঔপন্যাসিক এর চরিত্রগুলোকে, বিশেষ করে বুধার চরিত্রটি এ লক্ষ্যেই গড়ে তুলেছেন।
কাকতাড়ুয়া উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বুধা। বুধাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এর কাহিনি । সে কিশোর কিন্তু ভীষণ সাহসী। ছেলেবেলায় সে ভয়ের গল্প শোনেনি। ভয় কী, তা-ই সে জানে না। বাবা-মা, ভাই-বোন মারা যাওয়ার কথা মনে হলে তার আর ভয় থাকে না। গাঁয়ের লোক তাকে পাগল বললেও সে আসলে এক 'সাহসী বালক'। একা একা বেড়ে উঠতে গিয়ে সে আরও সাহসী হয়ে ওঠে। চাচির বাড়ি ছেড়ে এলে তার মধ্যে মুক্তির বোধ জাগে। একা একা থাকতে থাকতে সে স্বাধীন মানুষ হিসেবে বড় হতে থাকে। ঔপন্যাসিক এভাবেই ভয়হীন এক কিশোর হিসেবে তাকে গড়ে তুলেছেন। এর পরই সে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধে। শান্তি কমিটি আর রাজাকার কমান্ডারের বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। ক্যাম্পের বাঙ্কারে মাইন পেতে রেখে আসে। ভয় পায় না। বুধার এই যে সাহসী হয়ে বেড়ে ওঠা এবং তারপর মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া- এই দিকটিকে সেলিনা হোসেন চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। বুধার চরিত্রের এই বিকাশ তাই খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়। কিশোর হিসেবে তার মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি এভাবেই যৌক্তিক হয়ে উঠেছে।
কাকতাড়ুয়া উপন্যাসে আরও বেশ কয়েকটি চরিত্র আমরা পাই। তারা খুব বড় ভূমিকা পালন করেনি। তবে উপন্যাসের কাহিনি গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে। এই চরিত্রগুলো হচ্ছে কুন্তি, নোলক বুয়া, হরিকাকু, আহাদ মুন্সি, আলি, মিঠু, ফুলকলি, রাজাকার কুদ্দুস ও মুক্তিযোদ্ধা শিল্পী শাহাবুদ্দিন। এই চরিত্রগুলো ছাড়া আরও একজনের প্রভাব এই উপন্যাসে স্পষ্ট। সেই মানুষটি হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। বুধা অনেক সময় যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা ভেবেছে, তখনই ছায়ার মতো তাঁর স্বাধীনতার আহ্বান বুধাকে উদ্দীপ্ত করেছে। সমগ্র উপন্যাসটি নির্মাণ করতে সেলিনা হোসেনকে এসব চরিত্রের সাহায্য নিতে হয়েছে। তিনি এর কাহিনিকে পাঠকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন।
উপন্যাসটির ভাষাভঙ্গি, পরিবেশচিত্রণ এবং বর্ণনারীতিও বেশ আকর্ষণীয়। শুরু থেকেই ছোট ছোট বাক্যে, অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে উপন্যাসের কাহিনি গেঁথে তুলেছেন ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন। বুধা যে মুক্ত মানুষ, সেটা বোঝাবার জন্য যে বর্ণনার আশ্রয় নিয়েছেন, তাও চমকপ্রদ। এ রকম প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ :
(ক) পথ ওকে ডাকে আয়। ও হেসে বলে, এই তো এসেছি। দেখ আমাকে। পথ ওকে দেখে ।
(খ) ঘুমুবার জায়গা নেই তো কী হয়েছে? দোকানের বারান্দা আছে, গাছতলা আছে, হাটের চালা আছে, ঘাটে বাঁধা নৌকা আছে।
(গ) সব বেলার ভাত নেই তো কী হয়েছে? ফলপাকুড় আছে, নদীর পানি আছে। নোলক বুয়ার মুড়ি ভাজা আছে। বুধা যে আপন স্বভাবে স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা এক কিশোর, এই বর্ণনায় আছে তারই ইঙ্গিত। মিলিটারির নির্মম হত্যাকাণ্ড আর যে বর্বরতার দৃশ্য সে দেখেছে, সেই বর্ণনাও সমান আকর্ষক :
গুলি। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সালাম চাচা।
গুলি। পড়ে গেল রবিদা ।
গুলি। পড়ে যায় একসঙ্গে অনেকে।
ধানগাছের আড়ালে উবু হয়ে বসে থাকতে পারে না ও। ওর শরীর কাঁপে থরথর করে। হাজার হাজার বোলতা ওর কানের চারপাশে উড়তে থাকে। ও পড়ে যায়। ওর শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। আবার বুধা যখন মিলিটারিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভাবে, তখনকার বর্ণনা এ রকম :
ও পলকহীন সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবছে। ভীষণ ভাবনায় ও গম্ভীর হয়ে যায়। ভাবে, ওদেরকে তো একদিন এ গাঁ থেকে চলে যেতে হবে। ওরা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই একদিন ফিরে যাবে। ওদেরকে যেতেই হবে। তবে ওদেরকে কি জ্যান্ত ফিরে যেতে দেয়া উচিত? এখানে পৌঁছানোর পর ঔপন্যাসিক সেলিনা হোসেন বুধার মধ্য দিয়ে ‘প্রতিশোধ' গ্রহণের কথা বলেন। এই হচ্ছে লেখকের জীবনভাবনা। অত্যাচারীর বিরুদ্ধে যে রুখে দাঁড়াতে হয়, প্রতিশোধ গ্রহণ করতে হয়, এই ভাবনারই প্রকাশ ঘটেছে এই উপন্যাসে। শুধু বড়রা নন, একজন কিশোরও যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারে, এ হচ্ছে সেই কাহিনি । গ্রামের অবহেলিত, প্রান্তিক এক কিশোরের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্প । নতুন প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, তারা এই উপন্যাসটি পড়ে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পাবে। উপন্যাসটির সার্থকতা মূলত এখানে ।
কাকতাড়ুয়া
সেলিনা হোসেন
রাত পোহালে দিনের আলো, সুয্যি ডুবলে আঁধার। ওর কাছে দুটোই সমান। হাটে-মাঠে ঘুরে বেড়ায়। ঘুরতে ঘুরতে যে কোথায় যায় সে হিসেব রাখে না। ওর কাছে পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ সব সমান। মনে করে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই ওর জন্য রাস্তা খোলা। পথ ওকে ডাকে— আয়। ও হেসে বলে, এই তো এসেছি। দেখ আমাকে ।
পথ ওকে দেখে। মাঠ-ঘাট ওকে দেখে। ও মনের আনন্দে দুপায়ে পথের ধুলো মাখে। কিসে যে ওর আনন্দ, কিসে কান্না, কেউ বুঝতে পারে না । ও বোঝে অনেক। সবার মাথার ওপর দিয়ে ওর দৃষ্টি ছুটে যায়। ও তাকিয়ে বলে, দেখ আমাকে । সবাই ওকে দেখে। ওকে দেখা কারও ফুরোয় না। ও এমনই। এই দিনযাপনে ওর কোনো কষ্ট নেই । ঘুমুবার জায়গা নেই তো কী হয়েছে? দোকানের বারান্দা আছে; গাছতলা আছে, হাটের চালা আছে, ঘাটে বাঁধা নৌকা আছে। নৌকার ছইয়ের ভেতর দিব্যি ঘুমিয়ে থাকা যায়। আর সেসব কিছু না পেলে গেরস্ত বাড়ির কাছারির বারান্দা আছে। আছে দরজাবিহীন ঢেঁকিঘর। টুক করে ঢুকে পড়ে গুটিসুটি শুয়ে থাকা যায়। গেরস্তের উঠোনে খড়ের গাদা আছে। খড় বিছিয়ে শুয়ে পড়লে কেউ দেখতে পায় না। অনেক রাতে ঘুম ভাঙলে মাথার ওপরে তারাভরা আকাশটা দেখতে পায়। পাশ ফিরে শোয়ার সময় টের পায় নেড়ি কুকুরটা খড়ের ওমে গা ডুবিয়ে ওর পাশে শুয়ে আছে। ওকে নড়তে দেখে আলতো করে গা চেটে দেয়। ভালোই লাগে ওর। ও আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। এমনই রাত কাটে ওর । রাত নিয়ে ওর কোনো ঝামেলা নেই ।
সব বেলার ভাত নেই তো কী হয়েছে? ফলপাকুড় আছে, নদীর পানি আছে। নোলক বুয়ার মুড়ি ভাজা আছে। চায়ের দোকানে কাজ করে দিলে চা-বিস্কুট জোটে। ওটুকু খেয়ে রাত কাবার করে দিতে পারে। তা ছাড়া কখনো-সখনো গেরস্ত বাড়িতে ছোট-খাটো কাজের ডাক পড়ে। তখন অড়হর ডালের সঙ্গে ভাত জোটে। নইলে কেউ নুন-পান্তা দেয়। কারও বাড়িতে চালের আটার রুটির সঙ্গে একটুখানি ঝোল পাওয়া যায়। বিয়েবাড়ি হলে ভাত-মাংস পায় পেটপুরে। ওর দিন চলে যায়। এসব নিয়ে ওর কোনো মন খারাপ নেই ।
ও ভয় পায় না। ভয় ওকে কাবু করে না। আসলে ভয় কী, তা ও জানেই না। ও ছোটবেলায় ভূতের গল্প শোনেনি । কেউ ওকে জুজুর ভয় দেখায়নি । ও তো নিজের নিয়মে বড় হয়েছে। যে ছেলে নিজের নিয়মে বড় হয় ভয়ের সঙ্গে তার দেখা হয় না। ভয় আড়ালেই থেকে যায়। তাই ছেলেটি চারদিকে খোলা চোখে তাকাতে পারে। কোনো ভয়েই ওকে চোখ বুজে ফেলতে হয় না। ভীষণ সাহস ওর । কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, কোথায় যাচ্ছিস, বুধা ?
সোনার ঘরে। সেটা কী?
ও হাত উল্টে পা বাড়ায়। ওই প্রশ্নের জবাব ও কাউকে দেয় না। যার ঘর নেই তার চারদিকে তো সোনার ঘরই থাকে। এটা কি বলে দিতে হবে? মাঝে মাঝে লোকজন এমন বোকার মতো প্রশ্ন করে, দেখে ওর হাসি পায় । হাসতে হাসতে নিজেকে বলে, মানুষের বোকামির সীমা নেই। ও তাইরে নাইরে করতে করতে পথে হাঁটে। গান গায়। গানে বুক উজাড় করে দেয় । গান ওর ভীষণ প্রিয়। আখড়ার গান শুনে ও গান শেখে। একবার শুনলেই গাইতে পারে। ওর মনে হয়, যার ভেতরে গান থাকে সে অনেক কিছু করতে পারে। সে একটা ভালো মানুষ হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ও পথের ধারে বসে পড়ে। ওর পায়ের কাছে মরা শামুকের খোল পড়ে থাকে। ও বুড়ো আঙুলের মাথায় সেটা তুলে নিয়ে নাচাতে থাকে। নাচাতে নাচাতে ও ঘাসের ওপর শুয়ে পড়ে। ওর পা উঠে থাকে আকাশের দিকে। ও হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে। ভাবে, এমন মজার খেলা বুঝি আর হয় না। ও হাতের ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় শামুকের খোলটা ওর বুড়ো আঙুলে টুপির মতো লাগছে। লোহার টুপি। বুড়ো আঙুলটা যদি একটা মানুষ হয়, তা হলে খোলটা মানুষের মাথায় একটি অন্যরকম টুপি। মানুষটা বুঝি যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হয়েছে। ছেলেটা এমন ভাবনায় নিজের চারপাশ ভরিয়ে তোলে । ওর দিন এভাবে চলে। কারও খেতে কামলা খাটে, কারও গরু চরায়, কারও মোট বয়। জেলে নৌকায় মাছ ধরে। মুদির দোকানে বসে কেনাবেচা করে। চায়ের দোকানে চা বানায়। খদ্দেরের সামনে চায়ের কাপ নিয়ে যায়। ধানখেতে নিড়ানি দেয়। আরও কত কী! ওর কাজের শেষ নেই। গাঁয়ের লোকে বলে, ও পাগল হয়নি । শক্ত হয়ে গেছে। জমে শক্ত হয়ে যাওয়া যাকে বলে।
চোখের সামনে মা-বাবা, চার ভাই-বোনকে মরে যেতে দেখলে কেউ কি নরম থাকে? নাকি থাকতে পারে? তার জীবনটা তো আর স্বাভাবিক নিয়মে চলে না। চলার উপায় থাকে না। কলজে খুবলে খায় শকুন। ও দুঃখকে হিংস্র শকুনই ভাবে। এসব ভাবলে ও মগজের ভেতরে শুনতে পায় শকুনের পাখা ঝাপটানি। শকুনের শক্ত চঞ্চুর ঠোকরানোর শব্দ। ওর সামনে জেগে ওঠে একটি ভয়াবহ কুটিল রাত। কী রকম ঘুটঘুটে অন্ধকার ছিল সে রাতে! নিস্তব্ধ গ্রাম। মাঝে মাঝে ভেসে আসে কুকুরের কান্না। মনে হয় কেউ যেন সে শব্দ দিয়ে বিনুনি গাঁথছে। সেই শব্দের বিনুনি পেঁচিয়ে রাখে বুকের চারপাশ। হঠাৎ করে কোনো বাড়িতে কান্নার রোল উঠলে ওর মনে হয় আকাশ ফুটো হয়ে একটা কঠিন বজ্রপাত ঘটে যাচ্ছে একের পর এক। ঘরের ভেতরে ওর বাবার শরীর মোচড়াতে থাকে। মোচড়াতে মোচড়াতে স্থির হয়ে যায় চোখের মণি। ঘরে একটিমাত্র কুপি। ফুরিয়ে আসছে তেল। ঘরে কেরোসিন নেই যে কুপিতে আর একটু তেল দেওয়া যাবে। কিংবা কুপিতে তেল দিতে হবে, পাশের ঘরে চাচির কাছে গিয়ে তেল চেয়ে আনতে হবে, এমন কিছু চিন্তা ও করতে পারেনি। তখন তো এসব ভাবনার সময় ছিল না। ও দেখতে পায় একপাশে পড়ে আছে মা। তার বুকে ছোট তিনু। তিনুর বয়স দেড় বছর। রোগা, প্যাকাটির মতো শরীর। বোঝা যাচ্ছে না যে ও বেঁচে আছে কি না। ও তিনুর গায়ে হাত দিয়ে শিউরে ওঠে। ঠাণ্ডা হয়ে গেছে শরীর। ওর বুকটা ধক করে ওঠে। তিনু ওর কোলে উঠতে খুব ভালোবাসত। ওকে দেখলেই দুহাত বাড়িয়ে আ-আ শব্দ করত। ও ওকে বুকে নিয়ে উঠোনে নেমে যেত। ঘুমপাড়ানি গান গাইত। ওর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেত তিনু। এখন ও কী করবে? তিনুর জন্যে কি একটা গান গাইবে? গান শুনে কি জেগে উঠবে তিনু? ওর কোলে ওঠার জন্য হাত বাড়িয়ে দেবে? ছেলেটির বুক খালি হয়ে যায়। দেখতে পায় ঘরের অন্য পাশে মেঝেতে গড়াচ্ছে শিলু আর তালেব। ওর ছোট দুজনে । দুজনে পিঠাপিঠি। ওদের সঙ্গেই তো ছেলেটির খেলাধুলো, ঘুরে বেড়ানো ছিল। কখনো ফলপাকুড় ভাগাভাগি নিয়ে ঝগড়া বেধে যেত। কত দিন দুজনকে দু-চার ঘা লাগিয়েছে, সে কথা মনে করে বুক ফেটে যায় ওর। পরক্ষণে কিছু বুঝে ওঠার আগেই ও দেখতে পায় ছোট ভাইবোন দুটো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে। তারপর শেষ। রাত পোহানোর আগে বিনুও চলে যায়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা, অথচ ওর জীবনের আকাশ-পাতাল উত্থাল করা সময়। বিনু ওর পিঠাপিঠি বোন। কত স্মৃতি ওর সঙ্গে। এত কিছু ও ভুলবে কী করে? সেই বিনু আর নেই। বিনুটার চোখ বুজে গেছে। আর কখনো ওই চোখজোড়া খুলবে না। অপূর্ব ছিল বিনুর চোখ। যেন পুরো একটা বিল ঢুকে আছে ওর চোখে। বিনু হাসলে মনে হতো বিলের জলে ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। ওর সামনে পুরা বাড়িটা স্তব্ধ হয়ে গেছে।
একসময় রাত পোহায়। সকাল হতে ও ঠাণ্ডা নিষ্প্রাণ শরীরগুলো হাত দিয়ে দেখে সব জমে শক্ত হয়ে গেছে। ও বুঝে যায়, জমে শক্ত হয়ে যাওয়া মানে মৃত্যু। ও কাঁদতে পারে না। নিজেকে আছড়াতে পারে না। অনুভব করতে থাকে ওর পায়ের নিচ থেকে শক্ত হয়ে যেতে শুরু করেছে। সে বোধ ক্রমশ ওপরের দিকে উঠতে থাকে। প্রথমে পায়ের পাতা । তারপর হাঁটু, ঊরু, কোমর, পেট, বুক, পিঠ, গলা, নাক, চোখ, কপাল এবং চুল শক্ত হয়ে গেছে। ও পাথরের চোখ মেলে মৃত্যু দেখে। সেবার কলেরায় মহামারিতে উজাড় হয়ে যায় গাঁয়ের অর্ধেক লোক। মাঝে মাঝে নিজের দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে, কীভাবে বেঁচে গেলাম। সেই মৃত্যু এবং অন্ধকার রাতের কথা মনে করলে ওর আর কোনো ভয় থাকে না। বুঝতে পারে না গাঁয়ের লোকে ওকে পাগল বলে কেন, আসলে ও তো একটি সাহসী বালক হয়েছে।
ও মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুহাত দুপাশে সোজা করে জামাটা মাথায় বেঁধে কাকতাড়ুয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে । দেখতে পায় কানের পাশ দিয়ে উড়ে যায় বোলতা। বোঁ করে একটা শব্দের তরঙ্গ উঠে মুহূর্তে মিলিয়ে যায় বাতাসে । ওর মনে হয় ওটা বোলতার ডাক নয়, শব্দটা ওর চাচির কণ্ঠ। চাচি ওকে সকালে মরিচ পুড়িয়ে পান্তাভাত খেতে দিয়ে বলছে, রোজ রোজ কেবল ভাত গেলা। ঢ্যাঙা তো কম হসনি। কামাই করতে পারিস না, বাপু? কামাই !
ভাত খেতে খেতে ও শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। শক্ত হয়ে থাকা মগজের গায়ে শব্দটা ঠোক্কর খায়। তোর মা-বাপ তো মরে খালাস। এখন জ্বালা আমার। পরের ছেলের বোঝা টানতে পারি না, বাপু । বোঝা! শব্দটা ওর শক্ত হয়ে থাকা বুকের মাটিতে বলের মতো লাফায়। ও ভাবতে থাকে। শোন বুধা, তুই তো দেখতেই পাস যে তোর চাচার রোজগার নেই। তোর আটজন চাচাতো ভাইবোন, দিন চলে না।
ও নীরবে ভাত খায়। পোড়া মরিচ ডলে ডলে ভাত লাল করে ফেলেছে। আশ্চর্য, ঝালে ওর জিব পুড়ছে না। কেমন অদ্ভুত স্বাদ হয়ে ভাতের লাল দলা গলা দিয়ে নামছে। শুধু ওর চোখে পানি আসতে চায়। কিন্তু সে পানিও বাধা পায়। গড়ায় না।
চাচি খানিকটা ধমকের সুরে বলে, কি রে কথা বলছিস না যে?
আমি কামাই করব ।
চাচির চোখ উজ্জ্বল হয় ।
সত্যি কামাই করবি?
নিজের বোঝা নিজে বইব।
সত্যি?
তাহলে তুই আমাকে মুক্তি দিবি?
হ্যাঁ, সত্যি।
মুক্তি! শব্দটি শুনে ও হোঁচট খায়। গলায় ভাত আটকে গেলে ও জোরে জোরে কাশতে থাকে। চাচি ওকে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয় ।
পানি খা, বাপু। এত অল্পে কেন যে তোর চোখ লাল হয়ে যায়। ছোটবেলায় তুই খুব লক্ষ্মী ছেলে ছিলি। একদম মায়ের নেওটা। এক রাতে মানুষগুলো মরে যাওয়ার পর তুই যে কেমন হয়ে গেলি! কিছু হলেই তোর চোখ লাল হয়ে
যায় ।
সত্যি আমার চোখ লাল হয়ে যায়?
হ্যাঁ রে, সত্যি। একটুও মিছে বলছি না।
আমি ভেবেছিলাম আমার চোখটা পাথরের চোখ হয়ে গেছে। কিছু দেখতে পাই না, চাচি।
না রে না, সে যে কেমন লাল আমি তোকে বোঝাতে পারব না। তখন তোকে দেখলে আমার সালাম করতে ইচ্ছে করে । মনে হয়, তুই আমার মুরব্বি। হয় আমার বাবা, না হয় চাচা। কেন যে আমাকে লজ্জা দেন চাচি।
তোকে লজ্জা দিতে চাই না রে। আমার কি সাধ্য যে-
ওর চাচি কথা শেষ করতে পারে না। আঁচলে চোখ মোছে। তারপর রান্নাঘরের দরজায় বসে গুনগুনিয়ে কাঁদে। চাচির কান্না ছেলেটি শুনতে পায় না। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। চাচির কথা শুনে ছেলেটি ভীষণ খুশি হয়। মনে হয়, নিজেই সেই বোলতাটার মতো শব্দ করতে করতে উড়ে যাচ্ছে। বাসনের বাকি ভাতটুকু ধীরেসুস্থে শেষ করে। বুঝে যায় ওর কোনো ভয় নেই। ও কতবার এমন করে নিজেকে আবিষ্কার করবে? কতবার নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারবে যে ওর ভয় নেই? আজ ওর ভারি আনন্দের দিন। লাল চোখের কথা ভাবতে ভাবতে ও একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। ও আর কখনো ওই বাড়িতে থাকার জন্য ফিরে যায়নি। গিয়েছে চাচির সঙ্গে দেখা করতে। কখনো ছোট ভাইবোনগুলোকে ফলপাকুড়ের ভাগ দিতে গিয়েছে। বারান্দায় বসে দুদণ্ড গালগল্প করেছে। চাচি আঁচল দিয়ে ওর মুখের ঘাম মুছিয়ে দিয়েছে। বোনেরা পানি দিয়েছে। গুড়-মুড়ি দিয়েছে। ও কখনো খেয়েছে, কখনো খায় নি। শুধু ওর মনে হয়েছে ও গেলেই কুন্তির চোখ ছলছল করত। ও একটি কথাও বলত না। চুপচাপ বসে থাকত। অপলক তাকিয়ে থাকত। ওই বাড়িতে গেলেই ওর বুক ভার হয়ে যেত। ও ওর শক্ত হয়ে যাওয়া বুকের বোঝা আর বাড়াতে চাইত না ।
যেদিন ও চাচির বাড়ি থেকে একবারের জন্য বেরিয়ে এলো সেদিন ভেবেছিল, সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার মানে কি মুক্তি? সম্পর্ক কি ভাঙা যায়? ছেলেটি উত্তর পায় না। বুঝতে পারে না সম্পর্ক কী? বাবা মরে গেলে কি চাচি পর হয়ে যায়? অথচ চাচাতো বোন ছোট্ট কুন্তি সম্পর্কের অধিকার নিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়েছিল। সেদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে কাঁদতে কাঁদতে ওর পিছে পিছে এসেছিল। বলেছিল, তুমি যেয়ো না, বুধা ভাই।
ও কুন্তির কথায় ফিরে তাকায়। কুন্তির কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর শুনে ওর চোখ থেকে লাল আভা মুছে যায়। ও বুঝতে পারে ওর বুকের ভেতরটায় জখম হয়েছে। ক্ষত থেকে রক্ত পড়ছে। আশ্চর্য, সম্পর্ক কী এমন? কুন্তি না হয়ে আর কেউ হলে ও কি এমন কষ্ট পেত? কুন্তি ওর হাত ধরে বলেছিল, তুমি যেয়ো না, বুধা ভাই ।
যাব না।
হ্যাঁ, যেয়ো না ।
কেন?
তুমি চলে গেলে আমার খুব খারাপ লাগবে।
খারাপ লাগবে? কেন?
কুন্তির কণ্ঠস্বর এক মুহূর্তে যেন বদলে যায়। ওর মনে হয় এই কণ্ঠস্বর ওর কাছে নতুন আবিষ্কার। ও কুন্তির মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, আজ যাই। আর একদিন আসব।
কবে আসবে?
গাঁয়েই তো থাকব। যখন মন চাইবে তখন আসব ।
এটা কি আসা হলো?
এটা আসা হলো না?
না, একটুও ভালো আসা না ।
ভালো আসা কী, আমি তো জানি না, কুন্তি। তারপর খুশি হয়ে বলে, ঠিক আছে আমি একদিন ভীষণ ভালোভাবে আসব । কবে? খুশিতে কুন্তির দুচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। কবে আসবে বুধা ভাই? তোর বিয়ের সময় ।
বিয়ে? আমার তো বিয়ে হবে না। বড় বুয়াদেরই তো বিয়ে হয়নি। আমাকে কে বিয়ে করবে? করবে, করবে। দেখবি লাল টুকটুকে বর আসবে।
তোমার মতো?
‘ধুৎ বোকা! আমার মতো হবে কেন? আমি কি একটা ছেলে হলাম? আমি তো এখন পথের ছেলে। এতিম। অনেক সুন্দর, অনেক ভালো বর পাবি তুই । কুন্তির চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল গড়ায়। ও কাঁদতে কাঁদতে বলে, তোমার মতো কেউ ভালো নয়। বুধা বলে, আমি যাই রে, কুন্তি। তুই বাড়ি যা। চাচি দেখলে তোকে বকবে। আমি চাই না আমার জন্য তোকে বকা খেতে হোক ।
কুন্তি পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদে। ছেলেটি পেছনে তাকায় না। ওর মনে হতে থাকে, কুন্তি যেন চিৎকার করে বলছে, তোমার মতো কেউ ভালো নয়। ও বুঝতে পারে না। ও যদি এতই ভালো হবে,তবে চাচি কেন ওকে সইতে পারল না? তা হলে সম্পর্কটা কি এমন যে কারও কাছে ভালো, কারও কাছে খারাপ? ভাবতে ভাবতে ও মাঠের মাঝখানে কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এটা ওর খেলা। এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকেই ও মানুষের আদর পেতে চায়। এই খেলা খেলতে খেলতেই ও বড় হতে চায়। ও দেখে কাঠফাটা রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে একসময় ওর মাথার ওপর শকুনের ছায়া নেমে আসে। ওকে দেখলে শকুনের বুঝি মনে হয় মরা মানুষ। তালগাছের ওপর থেকে সাঁই করে উড়ে আসে। আসলে কাকতাড়ুয়ার ভেতরে ও গাঁয়ের বেশির ভাগ মানুষকে দেখতে পায়। ওরা এমনই কাকতাড়ুয়া। ছন্নছাড়া। পথেঘাটের, হাটবাজারে। বাড়ি নেই। পেটভরা ভাত নেই। শুধু গাঁয়ের কয়েকজন মানুষ শকুনের মতো। কাকতাড়ুয়া ওদের ভয়ে তটস্থ থাকে ।
গাঁয়ের লোকে ওর নাম দিয়েছে কাকতাড়ুয়া। নোলক বুয়া ডাকে ছন্নছাড়া। হরিকাকুর জালে প্রচুর মাছ উঠলে ওর দিকে তাকিয়ে ফোকলা গালে হেসে বলে, মানিকরতন। পাকা ধান কাটার সময় জয়নাল চাচা ওকে বাবা ছাড়া কথা বলে না। বলে, সোনাবাবা। হাটের দিনে ডালাভরা বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে হাশেম মিয়া বলে, ও খোকনবাবু, আজ তুই আমার বাড়িতে ভাত খাবি। লোকটা বেশি সওদা করতে পারলে আত্মহারা হয়ে যেত। গাঁয়ের গোবর- কুড়ানি বুড়িটা ওকে গোবররাজা বলে ডাকে। অনেক দিন ও বুড়িকে গোবর কুড়িয়ে দিয়েছে। ওর তো অনেক নাম । এতে ও ভীষণ খুশি।
ওর মনে হয় ভালোই তো। যার যা খুশি সে নামেই আমাকে ডাকুক। একজনের অনেক রকম নাম থাকলে সেসব নামের ভেতর দিয়ে অনেক রকম মানুষ হতে পারে। ও অনেক রকম মানুষ হতে চায়। কেন? যেমন, কুন্তির ভাবনার মতো ভালো। নোলক বুয়ার ভাবনার মতো সাহসী। চাচির কথার মতো লাল চোখের মানুষ। ভরা মাছের জাল টেনে তুললে হরিকাকুর দুচোখের বিস্ময়ে লেখা হয় একটি শব্দ, শক্তিশালী। আর কী? বিশ্বাসী? হ্যাঁ। পরোপকারী? হ্যাঁ । সহৃদয়? হ্যাঁ। বন্ধুত্বসুলভ? হ্যাঁ। আর কী। সবকিছু, সবকিছু। ও ভাবতে ভাবতে ছুট দেয়। মাঠ পেরিয়ে, ঘাট পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে ছুটতে থাকে। ওর কল্পনায় ভেসে ওঠে তেপান্তরের মাঠ, পঙ্খিরাজ ঘোড়া, সাত সমুদ্র তেরো নদী ।
এভাবে ওর দিন ভালোই কাটছে। চাচির প্রতি ও কৃতজ্ঞ হয়ে ওঠে। ভাবে, চাচি ওকে মুক্তির কথা বলে স্বাধীন মানুষ হওয়ার স্বপ্ন দিয়েছে। কী মজা স্বাধীন মানুষ, স্বাধীন মানুষ। ও স্বাধীন মানুষ বলতে বলতে বাজারে এলে হাবু দোকানদার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, কী বলছিস রে, বুধা ? স্বাধীনতা।
স্বাধীনতা? দূর বোকা ।
ছেলেটি ঘাড় বাঁকিয়ে বলে, স্বাধীনতা ভীষণ আনন্দের। স্বাধীনতা খুব দরকার। আমি তো এখন স্বাধীন মানুষ। দোকানদার নিজের কাজে মন দিতে দিতে বলে, ছেলেটার পাগলামি গেল না। একদিন ও কাকতাড়ুয়া খেলার সময় দেখতে পায় গাঁয়ে মিলিটারি এসেছে। ও আগেই শুনেছে দেশে যুদ্ধ লেগেছে। মিলিটারি শহর-গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছে। কিন্তু মিলিটারি কেমন—তেমন কোনো ধারণা ওর ছিল না। থাকবেই বা কী করে। এর আগে গাঁয়ে তো কখনো মিলিটারি আসেনি। এসেছে পুলিশ। পুলিশ দেখে ওর ভয় লাগেনি । উল্টো পুলিশ গাঁয়ের রবি চোরকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় ওরা অনেক ছেলেমেয়ে ওদের পিছে পিছে থানা পর্যন্ত গিয়েছিল । হল্লা করে যেতে সেবার ওর বেশ মজাই লেগেছিল।
কিন্তু এবার মিলিটারি আসে জিপে করে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে। বুটের শব্দ যেন চড়চড় শব্দে ফুটছিল। যেন যেখানে পা পড়ছে সেই মাটি ফেটে চৌচির হয়ে ফুটছে। ও দূরে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। বড় সড়কের মাঝ বরাবর মিলিটারির জিপ থেকে ওরা ঝপঝপিয়ে নামে। ও ওদের বাজারের দিকে ছুটে যেতে দেখে। ও ধানগাছের আড়ালে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকে। একটু পর পর মাথা ওঠায়। কোন দিকে গেল লোকগুলো? পরক্ষণে ভেসে আসে আর্তনাদ। একটু পর বাজারের চালাগুলো দাউদাউ পুড়তে থাকে। ও আতঙ্কে ধানখেতের কাদায় মিশে যায়। অবাক কাণ্ড! ও বুঝতে পারে ওর মাথার মধ্য দিয়ে দ্রুত অনেক কিছু পার হয়ে যাচ্ছে। মিলিটারি চলে গেলে ও ছুটে বাজারের সামনে এসে দাঁড়ায়। কেউ কেউ হয় আগুনে পুড়ে, নয় গুলি খেয়ে মরেছে। অনেকে মারা যায়নি, কিন্তু আহত হয়েছে। যারা বেঁচে আছে তারা ছোটাছুটি করে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছে। ও নিজেও একটা মাটির হাঁড়ি নিয়ে ডোবা থেকে পানি আনে। পানি আনতে আনতে ওর রাগ বাড়তে থাকে। ও মনে মনে ফুঁসতে থাকে। প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ওর বুকের ভেতর টুপটাপ শব্দ তোলে। একসময় আগুন নিভে গেলে আধা-পোড়া বাজারটার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ লাল হতে থাকে। একজন ওকে বলে, কী হয়েছে, বুধা ?
কিছু না ।
আগুনের ধোঁয়ায় তোর চোখ লাল হয়ে গেছে।
আমার কিছু হয়নি ।
আমার সঙ্গে চল । আমার বাড়িতে থাকবি।
না। আমি এই বাজারে থাকব। আধা-পোড়া ঘরের ছাদের নিচে আমি ঘুমাতে পারব। লোকটি হাঁ করে থেকে মুখ ভেঙচিয়ে বলে, তুই মানুষ হবি না ।
মানুষ হব না, মানুষ হব না, মানুষ হব না বলতে বলতে ও আবার ছুটে যায়। ওর বুকের ভেতরে ভীষণ কিছু গজিয়ে উঠলে ও নদীর ধারে গিয়ে দাঁড়ায়। কান পেতে নদীর কুলকুল ধ্বনি শোনে। জলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে ওর দৃষ্টি জমাট হয়ে যায় ।
পরদিন গাঁয়ের অনেক মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে থাকে। ও প্রথমে নোলক বুয়ার কাছে ছুটে যায়। গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ। নোলক বুয়ার বাঁধাছাঁদা শেষ। কোথায় গেল তার মুড়ি ভাজার সরঞ্জাম! খ্যাংরা কাঠির ছড়া উঠোনে গড়ায়। মাটির হাঁড়ি উল্টে পড়ে ভেঙে আছে। মুড়ির টিনগুলো ঘরের চালায় ঝুলছে। বেরোনোর আগে নোলক বুয়া
ওকে জড়িয়ে ধরে ।
ছন্নছাড়া, আমার সঙ্গে চল।
কোথায়?
যেদিকে দুচোখ যায়। কোথাও না কোথাও একটা আশ্রয় তো জুটবে। কিন্তু কেন যাব?
নোলক বুয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তার মোটাসোটা শরীরটা নড়ে না। প্রবল বিস্ময়ে বলে, এখন কি জিজ্ঞেস করার সময়? প্রশ্ন করছিস যে? দেখলি না কত কী ঘটে গেল? ওরা তো আবার আসবে। তখন যাকে পাবে তাকে মারবে। আমরা কেউ বাঁচব না।
সবাই গেলে গাঁয়ে কে থাকবে?
শোনো ছেলের কথা! এখন কি এত কথা বলার সময় আছে? তোর হয়েছে কী বল তো? বাপ-মা, ভাইবোন সব তো গেছে। এখন কি তোর নিজের যাওয়ার শখ হয়েছে?
ও নোলক বুয়ার সঙ্গে কথা বলে না। নোলক বুয়া ওর কথার উত্তর দেয়নি । নোলক বুয়া কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়। ও নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে। ও তো জানে, কেউ না থাকলে ও একাই থাকবে। কেন পালাবে? যে পালায় সে ভীতু। বোকা। সবার তো উচিত গাঁয়ে থেকে লড়াই করা। লড়াই লড়াই বলতে বলতে ও হাঁটতে শুরু করে। অনেকে তখন পথে নেমেছে। ও সবার সঙ্গে কথা বলতে পারে না। কারণ, তারা ওর দিকে তাকানোর সময় পায় না। ওরা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। ভয়ে, আতঙ্কে ওরা পালাচ্ছে। বড় জামগাছটার নিচে দেখা হয় হরিকাকুর সঙ্গে। বেচারা লটবহরের বোঝায় কাহিল। হরিকাকুর জন্য ওর ভীষণ মায়া হয়। কত দিন ধরে কাকিমা অসুস্থ। ঠিকমতো হাঁটতেই পারছে না।
কাকিমা ওকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে ।
দেখ তো মানিকরতন, এই বয়সে কেউ কি বাড়িঘর ছেড়ে বেরোতে পারে?
কেঁদো না, , কাকি। পালাও। তোমাদের বাঁচতে হবে তো। তুমি তো লড়াই করতে পারবে না। শুধু শুধু ওদের হাতে মরবে কেন? তোমার বোঝা আমাকে দাও, কাকু। আমি তোমাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসি এগিয়ে দিবি কেন? মানিকরতন, তুই আমার সঙ্গে চল। তোকে গাঁয়ে রেখে যেতে আমার মন চায় না রে ।
তোমার সঙ্গে আমি কেন যাব? গাঁয়ে থাকবে কে? তোমার ভিটে দেখবে কে? চলো, তোমাকে খানিকটা পথ এগিয়ে দিয়ে আসি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেলা বাড়লে রোদে তোমাদের কষ্ট হবে। আমি তো চাই যে তোমাদের যেন কষ্ট না হয়। হরিকাকু ওর মাথায় বোঝা দিয়ে সোজা হয়ে হাঁটে। বড় সড়কের ধারে এসে বলে, এবার তুই যা। এখন আমি পারব। ফিরে এসে তোর সঙ্গে আমার দেখা হবে তো, মানিকরতন?
হবে গো, হবে। ভাবছ কেন?
ছেলেটি হরিকাকুর চলে যাওয়া দেখে। কত বয়স হলো কাকুর? হেঁটে যেতে পারবে তো? নাকি পথের ধারে মরে পড়ে থাকবে? তখন কে ওকে মানিকরতন ডাকবে? ওর চোখ ভিজে ওঠে। কণ্ঠে বলে, যাচ্ছি রে,
ফেরার পথে দেখা হয় রানির সঙ্গে। ওদের পুরো পরিবার চলে যাচ্ছে। রানি ভয়জড়ানো
কাকতাড়ুয়া । যা, ফিরে এলে দেখা হবে। ঠিকমতো যাস। ভয় পাস না ।
তুই কিন্তু আর কাকতাড়ুয়া খেলা খেলিস নে। মিলিটারি গুলি করতে পারে। দুষ্টুমি করিস না, কাকতাড়ুয়া । তোকে নিয়ে আমার ভীষণ ভয় হয়। তুই যে কী ঘটিয়ে ফেলবি কে জানে!
আমাকে নিয়ে তোর এত ভাবতে হবে না। তুই তোর পথে যা। তুই তো একটা ভীতুর ডিম। সে জন্য পালাচ্ছিস। আমি পালাব না। লড়াই করব।
লড়াই করবি?
হ্যাঁ, লড়াই, লড়াই। যা, যা ভাগ ।
রানি দুচোখে বিস্ময় ছড়িয়ে বলে, ইস কত বাহাদুর, যেন বীর! লড়াই করবে? সেদিনের ছোঁড়া, ঢঙ কত!
ও আর কথা না বলে হাসতে হাসতে পা বাড়ায়। ও কোথায় যাবে? চাচা কাজ খুঁজতে শহরে গিয়েছিল ছয় মাস
আগে। ফেরেনি । চাচি এখন গাঁয়ে নেই। ছেলেমেয়েদের নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। লোকমুখে এসব খবর পায় ও। চাচি তো ওর খবর রাখে না। ও নিজে খবর নিলে তবেই খবর পাওয়া । ওই বাড়িতে কুন্তিই ওকে নিয়ে যা একটু ভাবে। কখনো মোয়া-মুড়কি খেতে দেয়। এইটুকুই। অবশ্য এ নিয়ে ওর মাথাব্যথাও নেই।
আস্তে আস্তে গাঁয়ের মানুষের দিন সহজ হয়ে আসে। মিলিটারির আক্রমণের পর দুই মাস গড়িয়ে গেছে। যারা এদিক- ওদিক পালিয়ে গিয়েছিল একে-দুয়ে তারা অনেকে ফিরে এসেছে। শুনতে পায় অনেকে ইন্ডিয়া চলে গেছে। ইন্ডিয়া কোথায় ও জানে না। জানার দরকার নেই। নোলক বুয়ার কথা খুব মনে পড়ছে। কোথায় যে গেল কে জানে! হরিকাকুরও কোনো খবর নেই। যাদের কথা ও জানতে চায় তাদের খবর নেই। যারা ওর কেউ নয় তারাই আছে গাঁ-জুড়ে। ওর চাচিও ফিরে এসেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে দেখা হয়নি । ও যায়নি ওই বাড়িতে। শুধু দূর থেকে দেখেছে কুন্তি বড় হয়েছে। ওকে দেখতে এখন অন্য রকম লাগে ।
এর মধ্যে গাঁয়ে আবার মিলিটারি আসে। ক্যাম্প বানায়। ক্যাম্পের পাহারায় থাকে ওদের কেউ কেউ। রাইফেল হাতে সেই ক্যাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে ওদের দেখে। এমন মানুষ ও আগে কখনো দেখেনি। ওরা কোথা থেকে এসেছে? কোথায় ওদের দেশ? ওরা কি এ দেশের মানুষ? ওরা যে ভাষায় কথা বলে সেই ভাষাটা ও বুঝতে পারে না। গাঁয়ের মানুষ কেউই ভালো করে বুঝতে পারে না। দু-একজন ভাঙা ভাঙা ভাষায় কীসব বলে। সে ভাষা শুনতে আরও বিদঘুটে লাগে ওর । ওরা এ দেশের মানুষ হলে ও ওদের ভাষা বুঝতে পারবে না কেন? ও নিজের মতো করে ভাবতে পারে না। কেমন বিদঘুটে লাগে। বোলতাটা কোথা থেকে উড়ে এসে ওর মাথায় বসে। বোঁ বোঁ শব্দ ওর কানে ঢোকে । যেন ফটফট শব্দে ফেটে যাচ্ছে বাঁশ, বাজারটা পুড়ছে। সেদিনের দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে ফর্সা হয়ে যায় । সেদিনের পর একদিনও সেই দৃশ্যটা ও নিজের মগজে খোলসা হতে দেখেনি। আজ ক্যাম্পের সামনে একজন সৈনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর মাথায় দৃশ্যটা নতুন করে ফিরে আসে।
গুলি। মুখ থুবড়ে পড়ে গেল সালাম চাচা ।
গুলি। পড়ে গেল রবিদা ।
গুলি। পড়ে যায় একসঙ্গে অনেকে।
ধানগাছের আড়ালে উবু হয়ে বসে থাকতে পারে না ও। ওর শরীর কাঁপে থরথর করে। হাজার হাজার বোলতা ওর কানের চারপাশে উড়তে থাকে। ও পড়ে যায়। ওর শরীর কাদায় মাখামাখি হয়ে যায়। ও আবার উঠে বসে। দেখে পড়ে যায় মফিজ, শফি, মতি, আজাহার ভাই, মদন কাকু, শরিফ চাচা, আরও অনেকে। কারও নাম ভোলেনি ও । প্রত্যেকের নাম মনে আছে। চেহারা গেঁথে আছে বুকের ভেতর। একটা কিয়ামত ঘটিয়ে মিলিটারি চলে গেলে সেদিন বিকেলে গাঁয়ের আর সবার সঙ্গে লাশ দাফন করেছে ও। বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে এনেছে। বরই পাতা দিয়ে পানি সিদ্ধ করেছে। জানাজা পড়েছে। শুধু এই প্রথম ও কাফনের কাপড় ছাড়া কবর হতে দেখেছে। আর অনেক মানুষের একসঙ্গে একটা কবর হতে দেখেছে। ওর বারবার বলতে ইচ্ছে করেছিল যে, এমন করে কবর দিও না। সবাইকে আলাদা করে কবর দাও। কিন্তু বলতে পারেনি। শুধু হাবিব ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এই গাঁয়ে একটা গণকবর হবে আমরা কি কোনো দিন ভাবতে পেরেছিলাম? ও নিজেও কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করেছিল, গণকবর কী,হাবিব ভাই?
এই যে সবাইকে একসঙ্গে গাদানো।
গাদানো! ভীষণ কষ্টে ও শব্দটা নিজের ভেতর টেনে নেয়। তারপর বিড়বিড়িয়ে বলে, প্রতিশোধ! এমন হতে পারে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বলে ওর কষ্ট হচ্ছে। ওর ভেতরের বোলতাটা তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। ও পলকহীন সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভাবছে। ভীষণ ভাবনায় ও গম্ভীর হয়ে যায়। ভাবে, ওদের তো একদিন এই গাঁ থেকে চলে যেতে হবে। ওরা যেভাবে এসেছিল সেভাবেই একদিন ফিরে যাবে। ওদের যেতেই হবে । তবে ওদের কি জ্যান্ত ফিরে যেতে দেওয়া উচিত? একবার কলেরা মহামারি এই গাঁয়ে মৃত্যুর উৎপাত ঘটিয়েছিল। এবার মৃত্যুর উৎপাত শুরু করেছে ভিন্ন রকমের মানুষ। কলেরা সাত দিনের মাথায় চলে গিয়েছিল। এরা কি যাবে নাকি তাড়াতে হবে? কলেরাকে ও ছুঁতে পারেনি। কিন্তু ওই মানুষগুলোকে তো ছুঁতে পারে। ওদের হাত-পা-মাথা-বুক-পিঠ সব ছোঁয়া যায়। কলেরা যখন এসেছিল তখন ও ছোট ছিল। এখন ও বড় হয়েছে। গায়ে জোর আছে। সাহস আছে। বুদ্ধি আছে। তবে ছাড়বে কেন? ও বুঝতে পারে ওর, চোখ লাল হয়ে যায়। চোখ লাল হলে ওর ভেতরে একটা কিছু করার ইচ্ছা প্রতিজ্ঞা হয়ে যায়। ও বাজারে ফিরে আসে। ভাবে, কোথাও পালাবে না। দরকার হলে এই পোড়া ঘরগুলোর নিচে খেঁকশিয়ালের মতো গুটিয়ে-গাটিয়ে থাকবে। ও ছাই-কয়লা সরিয়ে ঘরের নিচে জায়গা করে নেয়। ঝাড়ু জোগাড় করে পরিষ্কার করে। বেশ ছিমছাম হয়। নিজের ছেঁড়া কাঁথাটা ভাঁজ করে এক জায়গায় রেখে দেয়। মাদুর বিছিয়ে নেয় মেঝেতে। বেশ লাগে এই পোড়া ঘর। ও চিত হয়ে শুয়ে দুহাত দুদিকে মেলে দেয়। ভাবে, ও এখন পোড়াঘরের কাকতাড়ুয়া। এভাবেই ও শিস বাজায়। শিস বাজাতে বাজাতে ওর ঘুম পায়। ও ঘুমিয়ে পড়ে। স্বপ্নে নিজের বুকের ভেতরে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাওয়া অনুভব করে।
অনেক রাতে কখনো কখনো গুলির শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ওর। ওরা কি কাউকে মেরে ফেলল? এত রাতে কাকে? কোন মায়ের বুক শূন্য হয়ে গেল? ও বিড়বিড় করে বলে, তোমরা যারা আমাদের ঘর পোড়ালে, বাজার পোড়ালে, মানুষ মারলে, গাঁয়ে গণকবর বানালে, লোকজনকে বাড়িঘর ছাড়ালে, তোমরা কি এমনি এমনি চলে যাবে? একটা ঘুষিও কি তোমাদের পাওনা হয়নি? আমরা কি এতই দুর্বল? কলেরা আমাকে খেতে পারেনি। আমি তোমাদের জন্য বেঁচে আছি। আমার হাত দিয়েই তোমাদের একটা কিছু পাওনা হবে। ঠিক, দেখো, একটা কিছু তোমাদের আমি দেবই। ও ছাদের ফুটো দিয়ে তারাভরা আকাশের দিকে তাকায়। তবে কি বঙ্গবন্ধু এই মানুষগুলোর বিরুদ্ধে লড়ার কথা বলেছিলেন? হ্যাঁ, এরাই তারা। ও ঠিক বুঝে গেছে। কারও কাছে জিজ্ঞেস করে এ কথা আর জানতে হবে না। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ও কানু দয়ালের বাড়িতে বসে রেডিওতে শুনেছিল। সেই রক্ত গরম করা ভাষণ শুনে ও মধুকে বলেছিল, এখন থেকে তোরা আমাকে বঙ্গবন্ধু বলে ডাকবি।
ইস শখ কত! বানরের আবার চাঁদে যাওয়ার সাধ।
কী আমি বানর?
হ্যাঁ, বানর। তুই একশবার বানর।
মধু হি-হি করে হেসেছিল। সেই মধু আর নেই। আগুনে পুড়ে গেছে। ও চিনতে পারে নি কোনটা মধুর লাশ। মধুর মা-বাবা গাঁয়েই আছে। এখনো পালায়নি। মধুর বড় ভাই মিঠু লুকিয়ে লুকিয়ে থাকে। জোয়ান ছেলেদের যে ওরা ধরে নিয়ে মারছে। এতকিছু ভেবে ওর ভীষণ কান্না পায়। দুইবছর আগের সেই শীতল মৃত্যুর রাতের কথা মনে পড়ে। সেই রাতে বাবা মারা যাওয়ার পরও মা জীবিত ছিল। ওকে ডেকেছিল। বাবা বুধা, বাবা, বাবা রে? ওহ সেই কণ্ঠ কেমন শীতল, যেন মৃত্যুপুরীর হাওয়া বয়ে এসেছিল ওর কাছে। ও হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল মায়ের ওপরে, মা, মাগো ।
বাবা, তোকে আল্লাহর ভরসায় রেখে গেলাম। বাবা রে- মাগো !
না, আর কোনো কথা ছিল না। আর কেউ ওকে কিছু বলেনি । টুপটুপ করে ঝরে গেছে কেবল। গাছ ঝাঁকানি দিলে যেমন বরই ঝরে পড়ে তেমন। ও পাগলের মতো চিৎকার করেছিল। ছুটে গিয়েছিল চাচার ঘরের দরজায়। বলতে চেয়েছিল, তোমরা দেখ, এই ঘরের ভেতর কী হচ্ছে। বলা হয়নি। ও মৃত্যুপুরীর স্তব্ধ শীতলতায় নিঃসাড় বসেছিল। ভাবলে এখন আর বুক মোচড়ায় না, শরীরটা তো জমাট শক্ত হয়ে গেছে। হঠাৎ মনে হয়, কে যেন ডাকছে।
বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু!
এই তো আমি এখানে ।
ও উঠে বসে। কোথাও কেউ নেই। ও নিজের বুকের কথাই শুনতে পাচ্ছে। ফুটো ছাদ দিয়ে বাতাস ভরে যাচ্ছে ভাঙা ঘরে। ও বুকভরে শ্বাস টেনে বসেই থাকে। কদিন ধরে ও খেয়াল করছে গাঁয়ের কয়েকজন টাকাওয়ালা মানুষ; যারা গাঁ থেকে পালায়নি, তারা মিলিটারির সঙ্গে বেশ যোগাযোগ করছে। ওদের ক্যাম্পে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, মাছ, ডিম, দুধ পাঠাচ্ছে। সৈনিকগুলোর ভীষণ ফুর্তি। খায়দায় ঘোরাফেরা করে। দরকারমতো একে-ওকে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পের সামনে বেঁধে রাখে। নয়তো কোথায় যে গায়েব করে দেয় ওর আর খোঁজ পাওয়া যায় না। ও পোড়াঘরের নিচে বসে ছটফট করে। মিলিটারি তো বিদেশি মানুষ। ওরা এ গাঁ চেনে না। ভাষা জানে না। ওদের আপন ভাবা যায় না। কিন্তু দেশের মানুষ কেন ওদের সঙ্গে মিশেছে? কেন বিদেশিদের মতো আচরণ করছে? গাঁয়ের মানুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে ক্যাম্পে? তারপর ওদের লাশ খেতে উড়ে আসে শকুন। বিদেশি মানুষ এবং নিজেদের মানুষ সবার ওপর ওর ঘৃণা বাড়তে থাকে। ভোর হলে ও পোড়া ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। দিনের বেলা ও নিজের বুকের কথা শুনতে পায় না। রাতই ওকে তাড়ায় বেশি। ওর ভীষণ খিদে পেয়েছে। খাবে কী?
ও বাজারের মাঝ দিয়ে হাঁটতে থাকে। কেউ কেউ আবার নতুন করে দোকানঘর তোলার চেষ্টা করছে। আলি কড়ইগাছের নিচে বাঁশের বেঞ্চি বানিয়ে চা বিক্রি করতে শুরু করেছে। আলি ওকে বলেছে, ওই শত্রুদের না তাড়িয়ে আমি আর চায়ের দোকান বানাব না। তুই যত দিন খুশি ওই পোড়া ঘরে থাকবি। ওকে দেখেই আলি ডাক দেয় ৷
বুধা, এদিকে আয়।
খিদে পেয়েছে, আলি ভাই ।
নে, চা-বিস্কুট খা। এতে হবে না?
খুব হবে। আমি কি কোনো দিন দুটো বিস্কুট একসঙ্গে খাই?
আলি হাসতে হাসতে বলে, আমি তো জানি তুই কী খাস! রোদ খেলে তোর পেট ভরে। জোছনা খেলে তোর মন ভরে। বৃষ্টির পানি খেলে তোর বুক ভরে, বাতাস খেলে তোর মগজ ভরে, তুই আর কী খাস রে, বুধা?
ও প্রবল হাসিতে ভেঙে পড়ে। ততক্ষণ ওর বিস্কুট খাওয়া শেষ হয়েছে। ও চায়ের কাপে চুমুক দেয়। আলি দেখতে পায় তৃপ্তিতে ওর মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। একে-দুয়ে মানুষ এসে বসে। বড় গলায় কথা বলে না। চুপচাপ থাকে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে, চোখ ভিজে ওঠে। কারও কারও চোখে আগুনের ফুলকি ছোটে। কেমন করে যে তাকায়, তা বোঝা যায় না। ছেলেটির মনে হয় এ গাঁয়ের কারও এমন দৃষ্টি ও কোনো দিন দেখেনি। মানুষগুলো বদলে যাচ্ছে। একদিন সবাই মিলে অবাক হয়ে শোনে, গাঁয়ে শান্তি কমিটি হয়েছে। আহাদ মুন্সি চেয়ারম্যান। ছেলেটি বুঝে যায় গাঁয়ের মানুষ দুভাগ হয়ে গেছে। এক দল আলির চায়ের দোকানে এসে বসে। নিজেদের মধ্যে কিছু কথা বলতে চায়। অন্য দল আহাদ মুন্সির দলে। মিলিটারির ক্যাম্পের পাশে ঘোরাফেরা করে। আকস্মিকভাবে ও চেঁচিয়ে ওঠে, 'যুদ্ধ, যুদ্ধ!' মানুষ যখন দুভাগ হয়ে যায় তখন তার মধ্য দিয়ে যুদ্ধ নামের নদী বইতে থাকে। এখন থেকে ওর নাম যুদ্ধ। ও নিজের ভেতরে জোশ অনুভব করে। একছুটে বড় সড়কের ধারে আসে। আর একছুটে নদীর ধারে যাওয়ার সময় মুখোমুখি হয়
আহাদ মুন্সির। ও বিনীত ভঙ্গিতে হাত উঠিয়ে বলে, স্লামালেকুম, চেয়ারম্যান সাহেব।
আহাদ মুন্সি বিগলিত হেসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। ছেলেটির সরল চেহারা দেখে তার মায়া হয়। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে, তোর নামটা যেন কী রে? মনে করতে পারছি না।
আমার নাম যুদ্ধ ।
যুদ্ধ? আহাদ মুন্সির চোখ কপালে ওঠে। বলিস কী? তুই কি পাগল নাকি ?
পাশে দাঁড়ানো লোকটি ঝটপট বলে, হ্যাঁ, হুজুর একদম পাগল। আরেকজন বলে, চলেন চেয়ারম্যান সাহেব, ওটা তো একটা পাগল পোলা। ওই যে কলেরায় ওর মা-বাবা সব মরেছে না! এক রাতে সব শেষ। তারপর থেকে ওর মাথার ঠিক নাই । আহা রে, আসিস আমার বাড়িতে। গরু চরানোর কাজ দেব। পেটেভাতে থাকবি । কিন্তু একটা কথা, চেয়ারম্যান সাহেব....
কী? কিছু বলবি? টাকা দিতে পারব না, বাপু। আমার পকেটে এখন টাকা নাই ।
আমি আপনার কাছে টাকা চাই না। আমি যার-তার কাছে হাত পাতি না ।
কী বললি? বললাম, আপনি তো শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। কিন্তু সারা দেশে যে অশান্তি। শান্তি কই?
চুপ বেয়াদ্দব! নাম রাখলেন বেয়াদ্দব? ভালো । কেউ আমার নতুন নাম রাখলে আমি খুব খুশি হই ।
‘বেয়াদ্দব, বেয়াদ্দব’ বলতে বলতে ও পথে নামে । তারপর হা-হা করে হাসতে থাকে। ওর হাসির তোড় আহাদ মুন্সির দুকানভরে বাজে। লোকটি ভুরু কুঁচকে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। যাওয়ার কথা ভুলে যায় । চেয়ারম্যান সাহেব চলেন ।
যাব! আহাদ মুন্সি অন্যমনস্ক কণ্ঠে বলে।
হ্যাঁ, যাবেন তো। একটা বানরের কথায় আপনি এত কী ভাবছেন?
ভাবছি না তো ।
তা হলে?
চল যাই ।
আহাদ মুন্সি হাঁটতে থাকে। কিন্তু বাকি পথটা সে আর কারও সঙ্গে কথা বলে না ।
বিকেলে চায়ের দোকানে বসে থাকার সময় ছেলেটির মনে হয় আলি আর মিঠুকে একদম একরকম লাগছে। দুজনের চেহারায় অদ্ভুত ছায়া খেলছে। ও মনে মনে বলে, আশ্চর্য। আমি যে কথা ভাবছি ওরা ঠিক সে কথাই ভাবছে। কেমন করে এমন ভেতরে ভেতরে এক হয় মানুষ? এক হওয়ার এখনই তো সময়। এক হতে না পারলে এই বিদেশি সৈনিকগুলো ওদের মেরে ভূত বানিয়ে ফেলবে। গ্রামটা হয়ে যাবে একটা শ্মশান। যেখানে মানুষ থাকবে না, থাকবে মানুষের প্রেত । ভাবতে ভাবতে ও হি হি করে হাসে। হাসতে ওর মজাই লাগে। মিঠু বলে, হাসছিস কেন, বুধা ?
ভূত।
আলি ও মিঠু একসঙ্গে বলে, ভূত কী রে? আমরা লড়াই না করলে গ্রামটা একদিন ভূতের বাড়ি হবে। না, ভুল বললাম। ভূত না, গ্রামটা ভরে যাবে মানুষের প্রেতে। ওরা সংখ্যায় বেশি হবে না। কিন্তু ওদের বড় বড় পা, হাত, মাথা দিয়ে ওরা গ্রামটা ভরে ফেলবে। কী বলছিস, বুধা?
হি-হি করে হাসে ও। হাসতেই থাকে। আলি বলে, আবার হাসছিস কেন?
আপনাদের দুজনকে একরকম দেখাচ্ছে। আপনারা কী দুজন না, একজন?
তুই তো বেশ ধেড়ে ছেলে রে।
আলি ও মিঠু এবার হাসতে থাকে।
আপনারা হাসেন কেন?
আমরা তোকে বুঝতে পারছি রে।
কেমন?
তোকে ধরলে আমরা এখানে তিনজন। কিন্তু আমরা তিনজন নই, একজন। ঠিক না? হ্যাঁ ঠিক ।
ছেলেটি গম্ভীর হয়ে বলে।
মিঠু জিজ্ঞেস করে, তিনজন একজন হলে কী হয়, জানিস তো?
জানি । শক্তি বাড়ে। বড় শক্তি হয়। এক হলে লড়াইয়ে শত্রুরা হারে।
শাবাশ । তোকে দিয়েই হবে।
ফেরার সময় ছেলেটি আলির কাছ থেকে এক শিশি কেরোসিন চেয়ে নিয়ে আসে। বলে, 'আমি গায়ে খেটে তোমার তেলের দাম শোধ দেব, আলি ভাই।'
ওইটুকু তেলের দাম শোধ দিতে হবে না ।
হ্যাঁ, দিতে হবে না । আমরা জানি তুই ভালো একটা কিছু করার জন্য তেল নিয়েছিস। মিঠুকে সমর্থন করল আলি।
দুজনে গভীর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ও হেসে মাথা নেড়ে পথে নামে। পোড়া ঘরে ফিরে বুধা বাঁশের লাঠির মাথায় শুকনো পাট জড়িয়ে মশাল বানায়। চারটা মশাল। গভীর রাতে পথে নামে ও। গাছগাছালি, ঝোপঝাড়ের আড়ালে চুপিচুপি আহাদ মুন্সির বাড়ির দিকে এগোয়। গোয়ালঘরের পেছনে কচুর ঝোপ আর কলাগাছের পেছনে বসে শিশির কেরোসিন ঢেলে চারটা মশাল ভিজিয়ে নেয়। তারপর দেশলাই ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে বড় মশালটা ছুড়ে মারে আটচালা ঘরের ওপর। একটা কাছারিঘরের ওপর। আর একটা রান্নাঘরে। অন্যটা গোয়ালে । দাউদাউ জ্বলে ওঠে ছনের চালা। মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে যায়। ঘুমন্ত মানুষগুলো জীবন নিয়ে বেরিয়ে আসতে ব্যস্ত। ঘর বাঁচানোর খেয়াল কারও নেই। অল্পক্ষণের মধ্যে বসতবাড়ি পুড়ে সাফ। মশাল ছুড়ে ও আর অপেক্ষা করে নি। সবাই যখন ছোটাছুটি, কান্নাকাটিতে ব্যস্ত তখন ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পালাতে থাকে। অল্পক্ষণে ফিরে আসে পোড়া ঘরে । একটু পর পায়ের শব্দ শুনে ও ফিসফিসিয়ে বলে, কে ওখানে?
জয় বাংলা।
ও বুঝে যায় আলির কণ্ঠ ।
আবার ধ্বনি হয়, জয় বাংলা। এটা মিঠুর কণ্ঠ ।
জয় বাংলা বলে, ও নিজেও বেরিয়ে আসে। ওরা দুজন জড়িয়ে ধরে ওকে। আলি বড় এক বোতল কেরোসিন ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, এই বোতলটা রাখ। দরকারমতো কাজে লাগাবি। এখন থেকে তোর নতুন নাম জয় বাংলা ।
তুই আমাদের শক্তি । আমাদের জয় বাংলা।
জয় বাংলা বলে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ব।
ছেলেটি হি-হি করে হাসে। ওর বুকের ভেতরে প্রাণের জোয়ার। উত্থাল-পাথাল বয়ে যায় ।
হাসছিস যে?
খুশিতে। উহ্ মাগো, এমন খুশি আমার জীবনে আর আসেনি। বাবা-মা-ভাই-বোন মরে যাওয়ার পরে আমি তো জানতামই না যে খুশি কী !
জয় বাংলা খুশি যা হয়েছিস তা ঠিক আছে। তবে ভুলে যাস না যে এখন কাজের সময়।
হ্যাঁ, হ্যাঁ জানি, সামনে আমাদের অনেক কাজ ।
কঠিন কাজ ।
বড় কাজ ।
ও আবার হি-হি করে হাসে। ওর হাসিতে তারার ফুল ফোটে। আলি আর মিঠু মুগ্ধ হয়ে ওকে দেখে ।
আমরা চলে যাচ্ছি, জয় বাংলা। আহাদ মুন্সি আমাদের ছাড়বে না। ঠিকই সন্দেহ করবে। আজ রাতেই পালাব। তুই সাবধানে থাকিস। তুই তো ছোট, তোকে এখনই সন্দেহ করবে না।
মিঠু ওকে জড়িয়ে ধরে।
আলি বলে, আমরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে যাচ্ছি। ওই মিলিটারি ক্যাম্পটা উড়িয়ে দিতে হবে। সময়মতো আসব জয় বাংলা। তুই ভয় পাস না ।
আমি তোমাদের জন্য তৈরি হয়ে থাকব। যখনই আসবে দেখবে আমি রেডি। শাবাশ । তোকে দেখেই বুঝতে পারছি যে দেশটা স্বাধীন হবে।
তোকে দেখে আমাদের সাহস বেড়ে গেছে। এখন আমাদের মরতেও ভয় নেই । দুজনে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ওর মনে হয় অন্ধকার ওদের বুকে টেনে নিল। আড়াল করে দিল সৈনিকগুলোর চোখের সামনে থেকে।
ওরা চলে গেলে সেই রাতে ও আর ঘুমুতে পারে না। কড়ইগাছের নিচে বাঁশের মাচাটার ওপর চিতপাত হয়ে শুয়ে থাকে। আকাশের হাজার নক্ষত্র দেখে। আজ ওরা ওর নাম রেখেছে জয় বাংলা। এক তীব্র আনন্দ ওকে এমন করে ভরিয়ে রাখে যে ও ভুলে যায় দুঃখ-বেদনার কথা। ও ঘুমিয়ে পড়ে।
এই শুয়োরের বাচ্চা, ওঠ।
ভোরবেলা আহাদ মুন্সির বড় ছেলে ওকে কান ধরে টেনে তোলে। ও ঘুম-জড়ানো চোখে মতিউরের দিকে তাকায় । শুয়োরের বাচ্চা? ও ঠিকমতো চোখ খোলে।
আলি কোথায়?
জানি না ।
তুই জানিস, বল?
কেমন করে জানব? আলি আমার কে? ও কি আমার মায়ের পেটের ভাই?
ইস, ঢং দেখানো হচ্ছে। একটা পিচ্চি শয়তান। আমাদের বাড়িতে আগুন দিয়েছে কে?
আগুন!
আগুন কী জানিস না? মতিউর রেগেমেগে ওকে থাপ্পড় দেওয়ার জন্য হাত ওঠানোর সঙ্গে সঙ্গে ও দু-পা পিছিয়ে গিয়ে আগুন আগুন বলে চিৎকার করতে করতে নদীর ঢালু বেয়ে নেমে যায়। অনেকখানি নেমে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকায়। দেখে মতিউর একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ও ওর আচরণের হদিস করে উঠতে পারে না। ছেলেটি ওর দিকে তাকিয়ে জিব বের করে ভেংচি কাটে। তারপর কাকতাড়ুয়া সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। মতিউর নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে ওকে গালাগাল করে, তোর সামনে খারাপ দিন আছে,বুধা। তোকে পেলে আমি চিবিয়ে খাব। বান্দর একটা। মনে রাখিস
মতিউরের হম্বিতম্বিতে লোক জড়ো হয়।
একজন বলে, ওকে মাফ করে দেন। ওর কি মাথা ঠিক আছে। বাপ-মা মরা ।
আরে রাখেন বাপ-মা মরা। বাপ-মা যেন আর কারও মরে না। মতিউর প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চলে যায়। বুধা নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে। ওর ঘাড় কাত করা। মাথার ওপর শুকনো পাতা ঝরে পড়ে। কেউ জানে না ও কখন ওর কাকতাড়ুয়া ভঙ্গি থেকে সরে আসবে । পরদিন গাঁয়ের রাজাকার কমান্ডারের বাড়িতে আগুন লাগে। পুড়ে যায় সবগুলো ঘর। শুধু মানুষের জীবন বাঁচে, আর গরু-ছাগলগুলো বাঁচানো যায়। কোথা থেকে কীভাবে আগুন লাগল – হদিস করতে পারল না বাড়ির লোকজন। রাজাকার কমাণ্ডার কাজের মেয়েটিকে আচ্ছা করে পিটিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল। তার ধারণা, কাজের মেয়েটি রান্না করার পরে নিশ্চয় পাঠখড়িগুলো চুলোর পাশে রেখে দিয়েছিল। সেখান থেকে আগুন লেগেছে। বাড়ির বাইরের জামগাছের নিচে বসে মেয়েটি অনেকক্ষণ কাঁদল। বুধা মেয়েটিকে দুটো জিলাপি দিয়ে বলল, খা । মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি পাটখড়ি চুলার পাশে রাখিনি, বুধা। আমি জানি না কীভাবে আগুন লাগল ।
বুধা ওর পাশে বসে। তারপর কোমরে গুঁজে রাখা মলমের ছোট্ট কৌটাটা ওর হাতে দিয়ে বলে, যেখানে যেখানে
কেটেছে সেখানে লাগিয়ে দে।
মলম?
হ্যাঁ, তোর জন্য এনেছি। রাজাকার কমাণ্ডার যখন তোকে মারছিল তখনই বুঝেছিলাম যে এই মলমটা তোর লাগবে । লাগিয়ে দে জ্বালাপোড়া কমবে। আহা রে যুদ্ধের জন্য আমাদের কত কিছু সইতে হয়। যুদ্ধ! মেয়েটি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকায়। যুদ্ধ কোথায়? আগুন লাগা কি যুদ্ধ? ধর,এক রকম তাই । আমি এমনি বললাম। তোর নাম কী রে?
ফুলকলি ।
চল আমার সঙ্গে।
কোথায়?
আতা ফুপুর বাড়িতে। ওখানে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে থাকবি।
এখন গেলে ওরা আমাকে মারবে।
মারবে না। এরা এখন ঘর-দুয়ার নিয়ে ব্যস্ত। এদের মেজাজ ঠাণ্ডা হোক, তারপরে আসবি। তোর তো কেউ নেই।
কোথায়ই বা যাবি। আয় ।
বুধা ফুলকলির হাত ধরে টানে। দুজনে সবার চোখ এড়িয়ে পথে নামে। যেতে যেতে ছেলেটি বলে, তোর কি খুব কষ্ট হচ্ছে, ফুলকলি?
মলম লাগানোর পর জ্বালা কমেছে।
যুদ্ধের সময় কত জ্বালা যে সইতে হয়। তুই বারবার যুদ্ধের কথা বলছিস কেন? তুই কি যুদ্ধ করছিস?
হ্যাঁ ।
কার সঙ্গে?
শত্রুর সঙ্গে।
শত্রু! তাহলে তুই-ই কি আগুন.....
আগুন! আগুন! আমাদের চারদিকে আগুন। আয় দৌড়াই।
বুধা ফুলকলির হাত ধরে হেঁচকা টান দেয়। মেয়েটি হোঁচট খেতে খেতে সামলে নেয়। একসময় দম নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে বলে, আমি সব বুঝতে পেরেছি, বুধা। আমি তোর শত্রু নই ।
আমি তো জানি তুই আমার শত্রু নস্। আমরা দুজনে এক। ওই বাড়িতে কিছু ঘটলে আমি তোকে জানিয়ে দেব।
ফুলকলি এখন থেকে তোকে আমি জয় বাংলা ডাকব।
জয় বাংলা, জয় বাংলা। জয় বাংলা, জয় বাংলা বলতে বলতে ফুলকলি আবার ছুট দেয়। এবার ওদের দম ফুরোয় না। ওরা একদৌড়ে আতা ফুপুর বাড়িতে এসে ওঠে। ফুলকলি ফিসফিসিয়ে বলে, এখন থেকে তোকে আমি যুদ্ধ ডাকব, বুধা ।
ডাকিস, তবে একা পেলে। সবার সামনে ডাকিস না ।
আচ্ছা। ফুলকলি ওর দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকায়। বুধা চেঁচিয়ে ডাকে, ফুপু, ফুপু। আমি এসেছি। খুব ভালো করেছিস। ওমা ফুলকলি যে? তোদের বাড়িতে আগুন লেগেছে না? মালিক ওকে খুব মেরেছে, ফুপু। তোমার হাঁড়িতে পান্তা আছে, ফুপু? আমাদের খেতে দাও ।
সেদিন ভোরবেলা আতা ফুপুর রান্নাঘরে বসে পেট ভরে পান্তা ভাত খায় ও। কী আনন্দ! অনেক দিন পরে আতা ফুপুর উঠোনে ও কাকতাড়ুয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বোলতাটা কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেলে মনে হয় বোলতার ডাকের ভেতর থেকে অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে। শব্দটা অন্য রকম। আগে শোনেনি। এটা কি যুদ্ধের শব্দ? রাইফেলের শব্দ ও চিনে গেছে। মেশিনগান কেমন তাও জানে। এসব মিলিয়ে যে শব্দ হয়, সেটাই বুঝি যুদ্ধের শব্দ। কাছ থেকে এই শব্দটি ওর শোনা হয়নি। ঠিক সে সময় রাজাকার কুদ্দুস ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। তোর মনে কি খুব আনন্দ? কাকতাড়ুয়া সেজেছিস কেন?
ও হি-হি করে হাসে। হাসির তোড়ে ওর কাকতাড়ুয়া ভঙ্গি আর ঠিক থাকে না। ওর শরীরে ঝাঁকুনি ওঠে। হাসছিস কেন? তোর হয়েছে কী? কমান্ডারের বাড়ি পুড়েছে তাতে গাঁয়ের মানুষ সবাই দুঃখ করছে। আর তুই হাসছিস? ঢং করে আবার কাকতাড়ুয়া সাজা হয়েছে! হাসব না কেন? কাকতাড়ুয়াকেও মানুষের মতো লাগে যে ।
বানর একটা।
ঠিকই, তোমার মতো। আমি তোমার মতো হয়েছি। কী আনন্দ ধেই ধেই । নৌকা চালাও হেঁইও । কুদ্দুস কষে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তোলার আগেই ও লাফ দিয়ে সরে যায়। হাতের কাছে পেলে তুলে একটা আছাড় মারব, শয়তান। মিঠু কোথায় বল? নদীর তলে খুঁজে দেখ। আমাকে জিজ্ঞেস কর কেন? আমি কি ওদের গাজ্জিয়ান ? শুয়োরের বাচ্চা।
মেশিনগান বল, আমার নাম মেশিনগান ।
হারামজাদা।
কুদ্দুস ওকে তাড়া করে। ও লাফ দিয়ে ছোটে। কচুরিপানাভরা পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে একডুবে ওপারে গিয়ে ওঠে। মাথার সঙ্গে লেগে থাকে কচুরিপানা। ওকে অন্য রকম দেখায়। ও মাথা থেকে কচুরিপানা সরায় না। ভাবে, ফুলকলি সামনে থাকলে হেসে গড়িয়ে পড়ত। বলত, তুই একটা ভাল্লুক। থলথলে চর্বিভরা শরীর। ফুলকলির অনেক দুঃখ। দেশটা স্বাধীন হলে ফুলকলির আর দুঃখ থাকবে না। ওর ভেতরে দেশ স্বাধীন করার জোশ জেগে ওঠে। পরদিন অনেক রাতে একজন মুক্তিযোদ্ধা আসে ওর কাছে। চুপিচুপি ডাকে, জয় বাংলা।
ওর সাড়া নেই। ঘুমে নিঃসাড়। ঘুমের ভেতরে স্বাধীনতার স্বপ্ন ওকে এক আশ্চর্য দেশে নিয়ে যায়। সেখানেও ও আর ফুলকলি হাত ধরাধরি করে হাঁটছে। চারদিকে ফুল-পাখিতে ভরা। হাজার প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। ও ধরার জন্য চেষ্টা করে, কিন্তু ধরতে পারে না। অন্যদিকে ফুলকলি শত শত প্রজাপতি ধরে ওর কোঁচড় ভর্তি করে ফেলে। ফুলকলি উজ্জ্বল মুখে ঘুরে বেড়ায়। তারপর একসময় ওর কাছে এসে বলে, বুধা, এ সব প্রজাপতি তোর জন্য। তুই যে আমার জন্য একটা যুদ্ধ জিতেছিস। ও চেঁচিয়ে বলে, আমি জিতেছি?
হ্যাঁ রে জিতেছিস। দেখ চারদিকে কেমন বাজি ফুটছে। দেখ তোর মাথায় আমি প্রজাপতি ছড়িয়ে দিচ্ছি। ও দেখতে পায় ওর পুরো শরীরে প্রজাপতি জামার মতো সেঁটে আছে। ও ভীষণ খুশি হয়ে একটি প্রজাপতি ধরে আকাশে ওড়াতে থাকে। ফুলকলি হাততালি দেয়। তখন ওর ঘুম ভেঙে যায়। কে যেন ওকে ডাকছে ।
বঙ্গবন্ধু? এই মেশিনগান?
ও ধড়মড়িয়ে উঠে বসে । আশ্চর্য, ঘরে এত আলো কেন? রাত না দিন?
এই যুদ্ধ উঠে আয় । কি রে তোর ঘুম কি ভাঙেনি? আমার ডাক কি তোর কানে পৌঁছাচ্ছে না? আশ্চর্য, কার কণ্ঠ? বোলতাটা কি কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল? ওর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, আমি তো তোমাদের জন্য বসে আছি। এত দিন আসোনি কেন? আমার কাছে পৌঁছাতে তোমাদের এত সময় লেগেছে কেন?
চুপ করে আছিস কেন, কাকতাড়ুয়া ?
ও হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে। ওকে দুহাতে বুকে জড়িয়ে ধরে মুক্তিযোদ্ধা শাহাবুদ্দিন। শাহাবুদ্দিন তো ছবি আঁকে। আর্ট কলেজে পড়ে। তা হলে শাহাবুদ্দিনও যুদ্ধ করছে। ওহ্ যুদ্ধ, যুদ্ধ । বুধা শাহাবুদ্দিনকে স্যালুট করে। শাহাবুদ্দিন ভুরু কুঁচকে বলে, কি রে স্যালুট করলি কেন? আপনি তো মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার। স্যালুট করব না? কী যে বলেন? ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুই একটা বাহাদুর ছেলে আমি শুনেছি। ছেলেটি হাসতে থাকে । তারপর শাহাবুদ্দিনের হাত ধরে মাচানের ওপর এসে বসে। আলি আর মিঠুর কাছে তোর কথা শুনেছি। তুই তো এই গাঁয়ে একাই যুদ্ধ করছিস।
যুদ্ধ? আমি? হ্যাঁ রে। ওই যে বাড়িগুলো পুড়িয়েছিস, এটাও যুদ্ধ। এবার বড় যুদ্ধ করতে হবে।
সেটা কী? মিলিটারির ক্যাম্পটা উড়িয়ে দেব আমরা। তুই থাকবি আমাদের সঙ্গে।
রেকি করার কাজটা তোকে করতে হবে।
এ আর এমন কী কঠিন কাজ, খুব পারব।
জানি তো তুই পারবি। শোন কয়টা সেপাই পাহারা দেয়, কয়জন তাঁবুর ভেতর থাকে, মেশিনগানটা কোথায় ফিট করে রেখেছে—সব খবর নিয়ে আসবি। আমি আবার দুদিন পরে আসব। যা ঘুমিয়ে পড়। কীভাবে ফিরবেন?
নৌকায় নদী পেরিয়ে চলে যাব। ভয় পাস না ।
ছেলেটি আবার নিজের খড়ের বিছানায় ফিরে আসে। গুটিসুটি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমুনোর আগে ওর মনে হয়, ভয় কী সে তো ও কবেই ভুলে গেছে। নতুন করে আর ভয়ের কী আছে ওর জীবনে। এখন তো ওর জীবনের চারদিকে তাক-ডুমা-ডুম ঢোল বাজছে। এই বাজনার নিচে ওর ভয় চাপা পড়ে গেছে। ওকে আর ভয়ের ভূত ধরতে পারবে না; বরং ও এখন ওর শৈশবের আনন্দের দিনগুলো খুঁজে পায়। যখন বাবা-মা বেঁচেছিল সে সব দিন। কত দিন বাবার সঙ্গে হাটে গিয়েছে। ইলিশ মাছ কিনেছে। মা রান্না করেছে। ইলিশের গন্ধে ওর ভাইবোনেরা বসে থাকত চুলোর পাশে। শীতকালে মা ভাপা পিঠা বানাত। কী আনন্দের ছিল সে সব দিন। স্বাধীনতার স্বপ্নে ও আবার
সে সব দিনের আনন্দ ফিরে পেয়েছে। এখন ওর আর কোনো ভাবনা নেই। মরণেও ভয় নেই । পরদিন ও একগাদা পেয়ারা নিয়ে মিলিটারি ক্যাম্পে যায়। গাঁয়ের স্কুলঘরটি দখল করে ওরা ক্যাম্প বানিয়েছে। সামনের মাঠে বেশ কতগুলো তাঁবু টাঙানো। ও এত দূর থেকে তাঁবু দেখতে পায় না। কিন্তু দৃশ্যটি ওর মাথায় আছে।
সেটা পরিষ্কার। দুপাশের ধানখেতের ভেতর দিয়ে সোজা চলে যাওয়া লম্বা পথটা পেরিয়ে ডান দিকে এগোলে স্কুলঘর। মা-বাবা মরে যাওয়ার পর থেকে ওর স্কুল বন্ধ। এর মধ্যে দুই বছর পেরিয়েছে। স্কুলের স্মৃতি ও মনে করতে চায় না। ওটা বুকের ভেতর বন্ধ করে রেখেছে। চমৎকার নকশা করা রঙিন একটা বাক্স আছে বুকের ভেতর। গত দুই বছরে সে বাক্স খোলার ইচ্ছে ওর হয়নি। এখন ওই স্কুলের দিকে যত এগোচ্ছে ততই মাথার ভেতর বোলতার শব্দ তীব্র হয়ে উঠছে। দুই বছরে কত হাজার বার স্কুলের আশপাশে ঘুরেছে। স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলেছে। রাতে স্কুলের বারান্দায় ঘুমিয়েছে, আর দুকান ভরে শুনেছে ঘণ্টার ঢং ঢং শব্দ। আশ্চর্য! মাথার ভেতর প্রবল শ্রাবণ মাস। রাতভর বৃষ্টি । ও ডান হাতের ওপর মাথা রেখে স্কুলের খেলার মাঠের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। কঠিন রাত। শেষ হবে না বুঝি। সেদিন ওর কেয়ামতের দিনের কথা মনে পড়েছে। মৌলবি সাহেব বলেছেন, কেয়ামতের দিন মাথার এক হাত ওপরে সূর্য নেমে আসবে। এমন বৃষ্টিমুখর শ্রাবণের রাতে ওর কেয়ামতের দিনের সূর্যের কথা মনে পড়ছে কেন? সূর্য কি শব্দ করে? বৃষ্টির শব্দ নয়, চারদিকে তুমুল ঘণ্টাধ্বনি। ঢং-ঢং-ঢং। কবেই তো স্কুলের দিনগুলো শেষ হয়ে গেছে। তুমুল ঘণ্টাধ্বনি কেন ওকে টানে? শ্রাবণ মাসের প্রবল বৃষ্টি ওর দুচোখ বেয়ে গড়াতে থাকে। ও মোছে না ।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই প্রথম স্কুলের দিকে যাচ্ছে। মাথার ওপর খাঁ-খাঁ দুপুর। চড়া রোদ। ও জানে, এই যুদ্ধের সময় আবার শ্রাবণ মাস এসেছে। বৃষ্টি নেই। চড়া রোদে ওর শরীর ঘামতে থাকে। জামার পকেটে পেয়ারা। কোমরে গোঁজা পেয়ারা। ডাঁসা। ও ভাবে, একটি পেয়ারা কি খাবে? ভাবতে ভাবতে অনেকটা পথ চলে আসে। পেয়ারাগুলো তো হাতে বন্দুক নিয়ে লোহার টুপি মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর জন্য নিয়েছে। ওদের সঙ্গে পেয়ারা খাওয়ার আড্ডা জমিয়ে তুলবে বলেই না এত ডাঁসা পেয়ারা সংগ্রহ করা।
নদীর ধারে গাছগুলোর পেয়ারা খেয়েই তো ওর রাত কেটে যায় । ও বেশ গান গাইতে গাইতে এগোতে থাকে । এগোতে এগোতে চঞ্চল হয়ে ওঠে। আশ্চর্য, এত কাছ থেকে সৈনিকগুলোকে ওর দেখা হয়নি । ওদের চোখে চোখ পড়লে ওর দৃষ্টি কেঁপে ওঠে না। ও বুঝে যায় প্রাণহীন দৃষ্টি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যে দৃষ্টিতে ভাষা থাকে না, সে রকম দৃষ্টিহীন মানুষকে ওর মানুষই মনে হয় না।
ক্যাম্পে পৌঁছে ও প্রথমে নিজে একটি পেয়ারায় কামড় দেয়। আরেকটি পেয়ারা এগিয়ে দেয় প্রথম সৈনিকটির
দিকে। ইশারায় বলে, খাবে?
লোকটি দাঁত কেলিয়ে হেসে পেয়ারাটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয় ওর হাত থেকে। কামড় দিয়ে বলে, বহুত আচ্ছা, বহুত মিঠা। আওর হ্যায়?
ছেলেটি সবগুলো পেয়ারা বের করে মাটিতে ফেলে দেয়। আশপাশ থেকে আরও দু-চারজন সেপাই এগিয়ে আসে। দুজন পেয়ারাগুলোর ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ভালোগুলো বাছতে থাকে। তিন-চারটে তুলে নিয়ে একজন জিজ্ঞেস
করে, তুমকো নাম কেয়া?
ও বিগলিত হেসে উত্তর দেয়, কাকতাড়ুয়া।
কেয়া বাত? কাক... । বাকিটুকু আর উচ্চারণ করতে পারে না। হেসে গড়িয়ে পড়ে সবাই। একজন ওর পিঠ চাপড়ে দেয়। ও ওদের পাশে পা ছড়িয়ে বসে চারদিকে দেখতে থাকে। ক্যাম্পের প্রতিটি জায়গা ও ক্ষিপ্র দৃষ্টিতে পরিমাপ করে। লোকগুলো বেশ মনোযোগ দিয়ে পেয়ারা খাচ্ছে। রোদে-গরমে ওদের গাল বেয়ে ঘাম গড়াচ্ছে। ওর হাসি পায়। হা-হা করে হাসতে থাকে। ঠিক সেই মুহূর্তে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আহাদ মুন্সি ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে, এই বেয়াদব, হাসছিস কেন? লোহার টুপি কি মানুষের মগজ খায়?
কী বললি? আহাদ মুন্সি ভুরু কুঁচকে তাকায় ।
ও আবার একই কথা বলে । আহাদ মুন্সির চোখ লাল হয়ে ওঠে
সেদিনও তুই আমার সঙ্গে বেয়াদবি করেছিলি। আজও করলি। তোর নাম কী?
কাকতাড়ুয়া ।
কাকতাড়ুয়া! ঠিক করে বল ?
কাকতাড়ুয়া
বলতে বলতে ও হেসে গড়িয়ে পড়ে। তারপর সুর করে বলতে থাকে, লোহার টুপি মানুষ খায়, মানুষ খায়...। আহাদ মুন্সি চেঁচিয়ে ওঠে, পাগল না ছাই। আস্ত বদমাশ একটা। এই, ওকে কাকতাড়ুয়া বানিয়ে রাখ । আহাদ মুন্সির সঙ্গে তিনজন রাজাকার ছিল। ওরা খুব মজা পায়। শক্ত করে দুহাত চেপে ধরে দু-চারটে ঝাঁকুনি
দিয়ে বলে, আর বদমাশি করবি তো জানে মেরে ফেলব। ঘুঘু দেখেছ, কিন্তু ফাঁদ দেখনি, চাঁদ । ওরা ওকে কাকতাড়ুয়া বানানোর উৎসবে মেতে ওঠে। হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায় মাঠের মাঝখানে। ও এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন? আমি তো হেঁটে যেতে পারি। ভয় পেয়ে আমি পালাই না ।
ইস, বড় বড় কথা।
বলবে না। বাপ-মা-ভাইবোন সব তো খেয়েছে।
খবরদার বাজে কথা বলবে না।
ইস, নবাব। নবাব হয়েছে। মারব এক থাপ্পড়।
মারো না মেরেই ফেল । লোকে জানুক যে আমি স্বাধীনতার যুদ্ধে শহিদ হয়েছি।
কী বললি?
যা বলেছি তা তো দুকান দিয়ে শুনেছই। আবার কী?
তখন একজন ওর গালে ঠাস করে চড় মারে। ও রুখে দাঁড়িয়ে বলে, আমি শোধ নিতে জানি ।
আবার কথা ।
দুজনে ওর দুহাত চেপে ধরে। অন্য জন পা ধরে চ্যাংদোলা করে নেয়। ও বলে, তিনজনে মিলে একজনকে মারছ লজ্জা করে না?
লজ্জা কিসের? মেরে ভূত করে ফেলব। তখন বুঝবি। আজ ছেড়ে দিলাম। বাপ-মা মরা ছেলে বলে রেহাই পেলি । ওরা ওকে মাঠের মাঝখানে এনে ধাম করে ফেলে দেয়। ও নড়েচড়ে না। উঠে দাঁড়ায় না। চিত হয়ে শুয়েই থাকে। চোখ বোজা। ওরা মাঠের মাঝখানে একটি বাঁশ পুঁতে বাঁশের সঙ্গে শরীরটা বাঁধে। আর একটি বাঁশের ওপর রাখে ওর ডান হাত। অন্যটিতে বাঁ হাত। ওর গায়ের জামাটা বেঁধে দেয় মাথায়। তারপর রান্নাঘর থেকে হাঁড়ির নিচের কালি এনে মুখে লাগায় । বুক-পিঠও আঁকাবাঁকা রেখায় ভরিয়ে দেয়। তারপর হি হি করে হাসতে হাসতে তিনজন রাজাকার চলে গেলে ওর চোখ জ্বলে ওঠে। কাঠফাটা রোদের দারুণ গরমে সেপাইগুলো দেখতে পায় ওর জ্বলে ওঠা চোখ। কিন্তু ওরা সে চোখের ভাষা বুঝতে পারে না। ভাবে, রোদে ছেলেটির খুব কষ্ট হচ্ছে। তা ছাড়া একটু আগে ওর দেওয়া পেয়ারা খেয়ে ওদের খুব মায়া হয়েছে। ওরা ওর নতুন ভঙ্গি দেখে। এভাবে কাউকে শাস্তি দেওয়া যায়, এটা ওদের ধারণায় নেই। ওরা জানে গুলি করতে, জানে যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলতে। তাই শাস্তির এই নতুন ঢংটায় ওরা মজাই পায়। অনেকক্ষণ ধরে ওকে দেখে। পেয়ারা খাওয়ার কৃতজ্ঞতায় ওর শাস্তি মওকুফ করে দেওয়ার কথা ওদের মনেই আসে না। ছেলেটির ভাষায়, লোহার টুপি ওদের মগজ খেয়েছে। সন্ধ্যার সময় ওরা ছেলেটির বাঁধন খুলে দিয়ে বলে, ভাগ হিয়াসে ।
ও ভাগে না। ওরা যেভাবে ভাগতে বলেছে, তার মানে ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ে পেরিয়ে যেতে হবে ক্যাম্পের সামনের মাঠটি। সেটা ও করতে পারবে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, এখানে ওকে আবার ফিরে আসতে হবে। ও খুব শান্ত পায়ে হেঁটে মাঠটা পার হয়। হাঁটতে কষ্ট হয়। মাথা ঝিমঝিম করে। কিন্তু শরীরের কষ্টটা তেমন নয়, ভেতরে সুখের পুঁটিমাছ রুপালি ঝিলিক তুলে সাঁতরায়। কত দিন আগে জেলেদের নৌকায় মাছ ধরতে গেলে জালভরা রুপালি পুঁটি দেখে ওর এমন আনন্দ হয়েছিল। কী আশ্চর্য, কোনো কোনো দৃশ্য কখনো মুছে যায় না। কোনো কোনো দৃশ্য অন্য আরেকটি ঘটনার রেশ ধরে হুবহু তেমন আনন্দ বা দুঃখ তৈরি করে । ও বুঝে যায়, আজ রাতে ওর পোড়া ঘরে একটি মশাল তৈরি হবে। সেটি পুড়িয়ে দেবে আহাদ মুন্সির নতুন তোলা ছনের ঘর।
পরদিন সকালে সেই তিন রাজাকার যখন ওকে খুঁজতে আসে, দেখতে পায় প্রবল জ্বলে ও কোঁকাচ্ছে। মা, মা বলে চিৎকার করছে। পানি খেতে চাইছে। খড়ের বিছনায় গড়াচ্ছে বলে খড়ের কুটো লেগে যাচ্ছে ওর গায়ে। ওকে ভয়ানক জীবের মতো লাগছে। কিম্ভূতকিমাকার। ওর পাশে কেউ নেই। নেড়ি কুকুরটা মাচানের নিচে চিত হয়ে শুয়ে আছে। চারদিকে সুনসান। ওদের ভয় করে। ওরা ওকে ডাকতে সাহস পায় না। ভাবে, ওকে ডাকলে ওর ভূতটা ওদের কাঁধে লাফিয়ে চড়বে। মেরেও ফেলতে পারে ওদের। ওরা দ্রুত পায়ে পালিয়ে যায়। একজন বলে, ছেলেটি শুধু পাগল নয়, আজ ওকে একদম ভূতের মতো লাগছে। কালি মাখানো মুখটা দেখে আমার গা ছমছম করছিল। ঠিক বলেছিস। আমারও ভয় করছিল। তা ছাড়া ছেলেটা কেমন করে যে কথা বলে। শুনলে গা হিম হয়ে যায়। আমার গায়ে কাঁপুনি ওঠে।
ওই ভূতটার তো জ্বর । তা হলে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আগুন দিল কে? আরেকজন রাজাকারের প্রশ্ন। ওর চেহারায় ও ভয়ের চিহ্ন। তিনজনে ভয়ে কাবু হয়ে গেছে । অন্যজন বলে, রাতের বেলা নিশ্চয় মুক্তিবাহিনীর কেউ আসে। আমি এখন বুঝে গেছি। আমাদের আরও জোরদার ব্যবস্থা নিতে হবে।
ঠিক বলেছিস। আমারও তাই মনে হচ্ছে। আমরা আরও সতর্ক না হলে মুক্তিবাহিনী আমাদের মেরে ফেলবে। দিন
দিন ওদের দাপট বাড়ছে।
আমার মনে হয় বুধারও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ আছে।
আরে ধুরো, ওইটুকু ছেলেকে কে পাত্তা দেবে। ও কি বন্দুক চালাতে জানে? নাকি গ্রেনেডের পিন খুলতে শিখেছে? বাপ-মা নাই তো এ জন্য মরণে ভয় নাই । পাগল ।
শুনলি না সেদিন কীভাবে শহিদ হওয়ার কথা বলল ।
আমার মনে হয় না ছেলেটা অত পাগল ।
জ্বর হয়েছে। পাশে তো কেউই নাই। দেখিস আজ রাতে ওটা মরবে। জ্যান্ত থাকতেই তো ও ভূত হয়েছে। ঠিক বলেছিস। তিনজনে হা-হা করে হাসতে হাসতে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। দুদিন পর গভীর রাতে একজন ওকে ফিসফিসিয়ে ডাকে, যুদ্ধ ও যুদ্ধ? জয় বাংলা? বঙ্গবন্ধু?
ও চমকে উঠে বসে। এত নামে ওকে ডাকলে ওর সব দুঃখ ধুয়ে যায়। যে নদী দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা দ্রুত বেগে চলে যায়, সে নদীটা এমন একটা নামের নদী হয়। নদীর নাম যমুনা, করতোয়া, না পদ্মা, সেটা ও ভাবতে চায় না। ভাবে, নদীর নাম জয় বাংলা বা বঙ্গবন্ধু হলে ক্ষতি কী?
ও দুই লাফে উঠে বাইরে আসে।
কেমন আছিস মানিকরতন?
ভালো । শাহাবুদ্দিন ভাই তুমি কেমন আছ?
তোর জ্বর ভালো হয়েছে রে?
ও হেসে ওঠে, ওটা তো ভাল্লুকের জ্বর। যায় আর আসে। যুদ্ধের সময় কি জ্বরের কথা এত ভাবলে চলে? না, না ভাবতে হবে। সুস্থ না থাকলে যুদ্ধ করবি কীভাবে? শরীরের তো শক্তি চাই। ঠিক বলিনি?
বলেছ। তুমি ছবি আঁকার মানুষ। তুমি তো ঠিকই বলবে। তাহলে আমার কষ্ট হবে কেন? সেদিন তোর খুব কষ্ট হয়েছিল, না রে?
যুদ্ধ করতে তোমাদের কি কষ্ট হয়?
না তো। কষ্ট হবে কেন?
শাবাশ ।
এবার কী করতে হবে, বলো ।
শুনেছি,ওরা একটা বাঙ্কার করবে। ক্যাম্পে বাঙ্কার করে ফেললে ওদের হারিয়ে দেওয়া কঠিন হবে। তার আগেই ক্যাম্পটা উড়িয়ে দিতে হবে। এই তো?
হ্যাঁ। আমি একটা মাইন নিয়ে এসেছি। যেদিন বাঙ্কারটা বানাবে সেদিন তোকে মাটিকাটার দলের সঙ্গে কাজ করতে হবে। কাজ শেষ হলে যেভাবে হোক এই মাইনটা মাটির নিচে রেখে আসতে হবে। পারবি তো? এ আর এমন কী কঠিন কাজ। খুব পারব।
সাবধান!
হি-হি করে হেসে গড়িয়ে পড়ে ও ।
হাসছিস যে?
হাসব না তো কী! তোমার কথা শুনে তো হাসি পায় ।
তুই কি জানিস, সাবধানে থাকাটা মুক্তিযুদ্ধের কৌশল?
জানি। আচ্ছা বলো তো ওরা বাঙ্কার করবে কেন?
ওরা বুঝতে পেরেছে যে নদীপথে এসে আমরা আক্রমণ করতে পারি। তা এমন সতর্ক ব্যবস্থা । ও আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে। হাসতে হাসতে ওর পেটে খিল ধরে। ওর হাসির শব্দে শাহাবুদ্দিন ভয় পায়। মনে হয়, ছেলেটা বেশি সাহস করছে। শাহাবুদ্দিন তখনই সিদ্ধান্ত নেয় যে, দেশ স্বাধীন হলে ও ছেলেটির একটি ছবি আঁকবে। না, একটি নয়, অনেকগুলো। যুদ্ধরত ছেলেটির নানা ভঙ্গির ছবি।
যুদ্ধ, এমন করে হাসিস না রে।
তুমি আমাকে হাসতে মানা করো না। তুমি চলে গেলে আমি একাই হাসব।
না, একা একা হাসিস না। তুই আমার সামনে বসে হাসবি। আমি তোর একটি ছবি আঁকব। সাহসী ছেলের ছবি।
তুমি আর এখানে বেশিক্ষণ থেকো না, শাহাবুদ্দিন ভাই ।
শোন, পরশু দিন সন্ধ্যায় আমি নৌকা নিয়ে তৈরি থাকব। ক্যাম্পটা যখন মাইন ফেটে হাউইবাজির মতো ছিটকে উঠবে, তখন আমরা নদীপথে সরে পড়ব।
ছেলেটি আবার হেসে ওঠে। হাসতে হাসতে বলে, ভারি মজার খেলা ।
যাই রে, জয় বাংলা ।
এসো । সাবধান। আবার দেখা হবে।
শাহাবুদ্দিন অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। ছেলেটি মাচার ওপর গালে হাত দিয়ে বসে থাকে। বাকি রাত ওর আর ঘুম আসে না । পরদিন ও ক্যাম্পে যাওয়ার পথের ধারে বসে থাকে। কখন মাটি কাটার দল আসবে? ও ঘোরাফেরা করে। ফড়িং ধরে। ঘাসের কচি ডাঁটা চিবোয়। ডোবা থেকে পানি তুলে খায়। কিন্তু সেদিন মাটি কাটার দল আর আসে না। দুপুরের পর রোদ কমে গেলে ও গুটিগুটি পায়ে মিঠুদের বাড়িতে হাজির হয়। রান্নাঘরের বারান্দায় পা গুটিয়ে বসে বলে, খালা, আমার খিদে পেয়েছে। সারা দিন খাইনি।
তোকে কত বলি রোজ এসে ভাত খেয়ে যাবি। কেন যে তুই আসিস না। আমার সামনে বসে তোকে ভাত খেতে দেখলে আমার কষ্ট কমে যায়। বুকের শূন্য জায়গাটা ভরে ওঠে। মনে হয়, এই বুঝি দেশটা স্বাধীন হলো ।
ও মৃদু হাসে। মিঠুর মা ওকে সানকিভরা ভাত দেয়। সঙ্গে বেগুন দিয়ে ট্যাংরা মাছের তরকারি। উহ্ কী মজা, কী আনন্দ! ও হাপুস-হুপুস খায়। মিঠুর মা দেখতে পায় ওর চোখে তারার আলোর ফুলকি। বলে, ছন্নছাড়া, আমার মধুকে তো পাকিস্তানিরা মেরে ফেলল। মিঠুও বাড়ি ছেড়েছে। মেয়েটা শ্বশুরবাড়িতে থাকে । তোকে পেলে তোর খালু আর আমি দুঃখ ভুলব। এখন থেকে তোকে আমি মধু বলে ডাকব, কেমন?
ও একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, শুধু মধু না, শহিদ মধু । শহিদ মধু? ও আমার মধু রে... বলে মিঠুর মা কাঁদতে শুরু করে। এ শুধু কান্না নয়, একে বলে গগনবিদারী চিৎকার । যাদের ছেলেরা শহিদ হয় – এ চিৎকার শুধু তাদের বুক ফুটো করে বেরিয়ে আসে। আর কারও কণ্ঠ এমন ধ্বনি ওঠাতে পারে না। ওর আর ভাত খাওয়া হয় না। ও থালা নিয়ে উঠে আসে। ঘরের পেছনে এসে ভাতগুলো ছিটিয়ে দেয়। কাকেরা উড়ে আসে।
ভাতের দানা তুলে নিতে থাকে ঠোঁটে। ও নিজেকে বলে, কী সুন্দর দৃশ্য! কাকেরা ভাত খেলে শহিদের মায়েদের বুক জুড়ায়। দেশ থেকে বর্গি পালায়। শহিদের মায়েরা কাকেদের ডানায় ভর করে উড়াল দিতে থাকে স্বাধীনতার খবর হাটে-ঘাটে-বাটে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ও আবারও বলে, কী সুন্দর দৃশ্য। যখন ও পুকুরের ঘাটে বসে সানকিটা ধুয়ে নেয়,তখন বুঝতে পারে খালার কান্না থেমেছে এবং খালা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নিচ্ছে।
পুকুরঘাট থেকে ফিরে এসে ও আস্তে করে বলে, যাই খালা ।
তুই আবার কবে আসবি?
জানি না। অনেক কাজ
রোজ রোজ এসে ভাতটা তো খেয়ে যেতে পারিস।
অনেক কাজ। আচ্ছা।
বিড়বিড় করে বলে ও ঘাড় কাত করে। মিঠুর মা জানে, ও আসবে না। তার বুক ভারী হয়ে ওঠে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। যেন কিছুক্ষণ আগে মিলিটারির ব্রাশফায়ারে নিহত হয়েছে মধু। গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে যাওয়া লাশটা আনা হয়েছে ওর মায়ের সামনে। মায়েরাই তো এমন। বুক উজাড় করে কাঁদে। সে কান্নায় পাখি গাছের ডালের বসে ডাকতে ভুলে যায় । স্তব্ধ হয়ে থাকে ঘাসফড়িং। নিভে যায় জোছনার আলো। মায়েদের কান্না সইতে পারে না কেউ । ভাবতে ভাবতে ওর চোখ ভিজে ওঠে।
পথে দেখা হয় কুন্তির সঙ্গে। ও একগাদা শাপলা তুলে বাড়ি যাচ্ছে। বুধাকে দেখে চকচক করে ওঠে ওর দৃষ্টি । বলে, কত দিন তুমি আমাদের বাড়িতে আসো না, বুধা ভাই । সময় পাই না রে। অনেক কাজ।
কী এত কাজ? আমাকে দেখতে তোমার ইচ্ছে হয় না? আমার ভীষণ ইচ্ছে হয় তোমাকে দেখার। কত দিন বাজারে গেলাম, কিন্তু তোমার দেখা পেলাম না ।
আমার অনেক কাজ, কুন্তি ।
কুন্তি শক্ত কণ্ঠে বলে, আমি জানি তোমার অনেক কাজ। আমিও তোমার সঙ্গে যুদ্ধ করব।
যুদ্ধ করবি?
না তো কী? করবই তো। তুমি শুধু বলবে, আমাকে কী করতে হবে।
চল, বাবা-মায়ের কবরটা দেখে আসি।
চলো । তুমি তো জানো না, যে আমি চাচা-চাচির কবর পরিষ্কার করে রাখি। ঘাস সাফ করি। শুকনো পাতা উঠিয়ে ফেলে দিই। আমি প্রতিটি কবরের মাথায় একটি করে গাছ লাগিয়েছি।
তুই এত কিছু করিস, কুন্তি ?
করি তো ।
কেন করিস?
তুমি তা হলে খুশি থাকবে এ জন্য।
কুন্তির দুচোখে ঝিলিক। বুধা ওর হাত জড়িয়ে ধরে। তারপর ওর হাত ধরে বাবা-মায়ের কবরের কাছে আসে। দেখতে পায় কুন্তি আকন্দ, ভাঁটফুল, ধুতরা—এসব গাছ লাগিয়েছে কবরের মাথায়। কী সন্দুর দেখাচ্ছে কবরগুলো। ও মায়ের কবরের সামনে বসে বলে, মা, তুমি আমাকে দোয়া করো। তোমার ছেলের মাথায় অনেক কাজ। সামনে অনেক কাজ করতে হবে। যদি তোমার সঙ্গে এখানে বসে আর কথা বলতে না পারি-
কুন্তি গলা উঁচু করে বলে, এসব কী কথা বলছ, বুধা ভাই। তুমি কোথায় যাবে?
যাব না, যেতে পারি ।
কোথায়?
আকাশে।
আকাশে কেন?
যদি ওই সৈনিকগুলো আমাকে মেরে ফেলে। যদি ওদের গুলিতে আমার বুক ফুটো হয়ে যায়।
ওহ্ আল্লাহ্ রে...। কুন্তি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।
কাঁদিস না । থাম। আমি তো জানি তুই ছাড়া আমার আর আপন কেউ নাই। তুই কাঁদলে আমার খুব কষ্ট হয় । কুন্তি কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে বলে, ছাই হয় ।
বুধা ওর মাথায় চাঁটি মেরে আবার বাবার কবরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে, তোমার ছেলে যেন তার আনন্দের
দিনগুলো ফিরে পায়, বাবা। যেন যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করতে পারে। বাবা, তুমি আমাকে দোয়া করো, যেন সাহস না হারাই । হঠাৎ করে ডুকরে কেঁদে ওঠে বুধা। অবাক হয় কুন্তি । ওকে কখন কাঁদতে দেখেনি। আজ কী হলো? বুধার কান্না থামলে কুন্তি চোখ গরম করে বলে, তুমি যুদ্ধ করতে ভয় পাচ্ছ? কাঁদছ কেন?
বুধা লজ্জা পেয়ে চুপ করে থাকে। কুন্তি তীব্র ভাষায় বলে, মরণের কথা মনে করলে যুদ্ধ করা যায় না। যুদ্ধ করলে
মরতে তো হবেই । কুন্তি! তুই একটা খুব ভালো মেয়ে ।
এই যে শাপলা তুলে এনেছি কেন জানো?
খিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য ।
খিদে না মরণ। যুদ্ধ ছাড়াও মরণ থাকে।
ছেলেটি অবাক হয়। কুন্তির আজ হলো কী? কুন্তি যেন ধাম করে বড় হয়ে গেল। এক রাতে বড় হওয়ার মতো জাদুর খেলা ।
যাই বাড়িতে । মাকে এগুলো দিলে মা রাঁধবে। তবেই না আমাদের খাওয়া হবে। তুমি অনেক দিন আমাদের বাড়িতে যাওনি। আজ চলো ।
হ্যাঁ চল । চাচিকে দেখে আসি ।
ও কুন্তির হাত ধরে হাঁটতে থাকে । পরদিন ও দেখতে পায় মাটি কাটার দল ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। ও এক দৌড়ে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
ফজু চাচা, আমি আপনাদের সঙ্গে মাটি কাটব।
পারবি? ওই তো শরীর। তোর গায়ে কি বল আছে? যা, ভাগ। কাজ না করলে খাব কী? আমার খিদে পায় না? আমার কি কেউ আছে?
ও ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। কান্নার এমন ধ্বনি তোলে যে অন্যরা থমকে যায়।
হয়েছে, হয়েছে, কাঁদতে হবে না। সবাই মিলে ওকে সান্ত্বনা দেয় ।
আয় আমাদের সঙ্গে। দলে থাকলে আহাদ মুন্সি তোকে না করতে পারবে না। ও দলে মিশে যায়। গামছায় পেঁচিয়ে মাইনটা কোমরের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে। গায়ে ঢোলা জামা। বোঝাই যায় না যে ভেতরে কিছু আছে। বাঙ্কার কাটা শুরু হয়েছে। সবাই ব্যস্ত। কোদালের কোপে উঠে আসছে মাটির ঢেলা। আহাদ মুন্সির ছেলে মতিউর
কাজের তদারকি করছে। লোকজনকে ধমকি-ধামকি দিয়ে অস্থির করে তুলেছে।
বুধাকে দলে নেওয়ার জন্য ফজু মিয়াকে বকাবকি করে। কিন্তু একটু পরে কাজে ওর আগ্রহ দেখে খুশি হয়। দৌড়ে দৌড়ে মাটিভরা ঝুড়ি নিয়ে ও পুব দিকে ফেলে আসতে যায়। মাটি ঢেলে খালি ঝুড়ি নিয়ে আবার দাঁড়ায় ফজু মিয়ার সামনে। ওর এমন চটপটে কাজের ভঙ্গি দেখে মতিউর মনে মনে প্রশংসা না করে পারে না। ভাবে, মা-বাবা মরে গিয়ে ছেলেটা বখে গেছে। নইলে একটা কিছু হতে পারত। দুপুর পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি দেখে ও খুশিমনে ভাত খেতে বাড়ি যায় ।
বিকেলের মধ্যে বাঙ্কারের কাজ শেষ। সবাই খুশি। সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে পারবে। ফজু মিয়া মুখ-হাত ধুয়ে গামছা দিয়ে মুছতে মুছতে ভাবে, যা দিনকাল পড়েছে, সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে কি থাকা যায়! ঠুস করে একটা গুলি এসে যে বুক ফুটো করে দেবে। এই শুয়োরের বাচ্চারা তো পাখির মতো মানুষ মারে । সেই মুহূর্তে ছেলেটি ফজু মিয়াকে বলে, চাচা, আমি একবার ভেতরটা দেখে আসি? বাঙ্কার কেমন এ তো আর এই জীবনে দেখা হবে না ।
যাবি তো যা। ভেতরে ঢুকে দেখে আয়। কিন্তু সাবধান, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরব আমরা।
ফজু মিয়ার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার কথা কে শুনতে চায়, ওর পায়ে ক্ষিপ্র গতি। মুহূর্তের মধ্যে বাঙ্কারে ঢুকে দুহাতে কাঁচা মাটি সরিয়ে পুঁতে ফেলে মাইনটা। তারপর শিস বাজাতে বাজাতে উঠে আসে। ফজু মিয়া জিজ্ঞেস করে, কি রে, কেমন হয়েছে?
দারুণ! ঢুকলে আর উঠতে মন চায় না। দেখো সেপাইগুলো ওটার ভেতর থেকে আর উঠতে চাইবে না।
ফজু মিয়া হাসতে হাসতে ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, পাগল । ছেলেটি চোখ নাচিয়ে বলে, রাতের বেলা ওরা বাঙ্কারে শুয়ে হাউইবাজি দেখবে। আহা রে আমি যদি এই বাঙ্কারে থাকতে পারতাম ।
ফজু মিয়া ওকে এক পাশে টেনে ফিসফিসিয়ে বলে, আল্লাহ্ মাফ করুক । এখানে থাকার ভাগ্য যেন আমাদের না হয় ।
এটা হলো ওদের কবর। ও ফজু মিয়ার পা ধরে সালাম করে ভোঁ দৌড় দেয়। কেন ও সালাম করল, কেন ও দৌড়াচ্ছে ফজু মিয়া বুঝতে পারে না। বোঝে, বেলা পড়ে আসবে। ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। ছেলেটি দৌড়াতে দৌড়াতে নদীর ধারে আসে। সন্ধ্যার আঁধার হয়েছে। ঝোপের ধারে লুকিয়ে থাকা শাহাবুদ্দিনের
কাছে পৌঁছে যায় ও । শাহাবুদ্দিন ওকে জড়িয়ে ধরে, তোর জন্য উৎকণ্ঠায় আমি প্রায় শেষ হয়ে যাচ্ছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ। পুঁতে রেখে এসেছি। কোনো ভুল হয়নি। এখন শব্দটা শোনার জন্য বসে থাকব।
শাবাশ ছেলে । নে, মুড়ি খা ।
দুজনে মিলে গুড়-মুড়ি খায়। পেঠ ভরলে আঁজলাভরা নদীর পানিতে তিয়াষ মেটায়। শাহাবুদ্দিন বলে, বাঙ্কারকে
সহজ করলে কী হয়, বল তো?
বাকার ।
আর একটু ছোট করলে?
বকার ।
আর একটু ছোট
বকর।
এবার মাঝখানের অক্ষরটাকে সামনে নিয়ে আয়।
কবর।
ও উত্তেজিত হয়ে বলে, বকর, বকর; কবর, কবর। শাহাবুদ্দিন ভাই ওদের কবর।
সেই মুহূর্তে কয়েকজন সেপাই বাঙ্কারে পজিশন নেওয়ার জন্য ঢুকলে পায়ের চাপে বিস্ফোরিত হয় মাইন। প্রচণ্ড শব্দ ছড়িয়ে পড়ে গাঁয়ে, সেই সঙ্গে আর্তচিৎকার। শাহাবুদ্দিন ছেলেটির হাত ধরে লাফিয়ে নৌকায় ওঠে। ক্যাম্পের উল্টোদিকে ছুটে যায় নৌকা। দক্ষ মাঝি এক টানে অনেক দূরে চলে আসে। সন্ধ্যার অন্ধকার চারদিকে। আকাশে ফুটিফুটি তারা।
ছেলেটি নৌকার পাটাতনে পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ে। দুহাত দুদিকে লম্বা করে মেলে দিয়েছে। কখন যে গায়ের জামাটি খুলে মাথায় বেঁধেছে,শাহাবুদ্দিন তা খেয়াল করেনি। ঠিক কাকতাড়ুয়া সেজে থাকার ভঙ্গিতে শুয়ে আছে। শাহাবুদ্দিন যখন বুঝতে পেরেছে যে ওরা বিপদসীমা পার হয়ে এসেছে, তখন থেকেই ওর ভীষণ গান গাইতে ইচ্ছে করছিল। মনে মনে সুর ভাঁজে। গলা খুলে গাইবার আগেই ছেলেটির দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায় ও। চোখের পলক পড়ে না । চারদিকের মাঠ, বাড়ি, ধানখেত, নদী, আকাশ গাছগাছালিজুড়ে ছেলেটি এক আশ্চর্য বীর কাকতাড়ুয়া। রুখে দিচ্ছে শত্রুর গতি। বুকের ভেতর ধরে রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ।
নিচের উদ্দীপকটি পড়ে ও প্রশ্নের উত্তর দাও :
‘কবর' নাটকে বর্ণিত ইন্সপেক্টর হাফিজ ভাই শহিদদের একটা গণকবরে মাটি চাপা দিতে চাইলে গোরখুঁড়েরা আপত্তি জানায়। তাদের বক্তব্য, 'মুসলমানের লাশ দাফন নাই, কাফন নাই তার ওপর আলাদা একটা কবর পাবে না তা হতে পারে না কভি নেহি।'